
দেশজুড়ে ছড়িয়েছে মাদকের নীল বিষ। মাদক সেবন ও বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে অহরহ ঘটছে খুনাখুনি। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ ১৮ পয়েন্ট এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ ১০টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন বিপুল ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য দেশে ঢুকছে। দেশের অন্যান্য সীমান্ত দিয়েও ঢুকছে মাদক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, জরুরি পণ্য পরিবহনের গাড়ি, অ্যাম্বুল্যান্স, যাত্রীবাহী বাস ছাড়াও ট্রেন ও নৌযানে দেশের সীমান্তসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ইয়াবাসহ কমপক্ষে ২৬ ধরনের মাদক পরিবহন করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি), পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্ট গার্ড—এই পাঁচ সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৬ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল) ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫৯৫টি মাদক মামলা এবং গ্রেপ্তার করা হয় ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৭৯ জনকে। এই ১৬ বছরে উল্লেখযোগ্য জব্দের মধ্যে ছিল ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৯৫ পিস ইয়াবা, চার হাজার ৫২৮ কেজি হেরোইন, ১৯৫ কেজি কোকেন এবং ৩৬৯ কেজি আফিম। মামলা, গ্রেপ্তার ও জব্দ বাড়লেও কারবার চলছে কৌশলে।
প্রধান ডিপো রোহিঙ্গা শিবির : কক্সবাজার থেকে বিশেষ প্রতিনিধি তোফায়েল আহমদ জানান, মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসা মাদকের প্রধান ডিপো কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে ইয়াবার চালানও ছড়িয়ে দেওয়া হয় রোহিঙ্গা শিবিরের ডিপো থেকেই। এখানে স্থানীয় মাদক কারবারিদের কারবারে ভাগ বসিয়েছে রোহিঙ্গারা।
মায়ানমার-কক্সবাজার-বান্দরবান হয়ে ঢুকছে : চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক নূপুর দেব জানান, মায়ানমার থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে চট্টগ্রামে অবাধে ঢুকছে ইয়াবা ও আইস। কক্সবাজার ও বান্দরবান থেকে সড়ক, নৌ ও রেলপথে কারবারিরা এগুলো চট্টগ্রাম নিয়ে আসেন। মাদক পাচারকারীরা চট্টগ্রামকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন। চট্টগ্রামে আনার পর কারবারিরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তা পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়া কুমিল্লা, ফেনীসহ পাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চট্টগ্রামে গাঁজা, ফেনসিডিল এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসছে চোলাই মদ। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ ১৮ পয়েন্ট এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িসহ আট থেকে ১০টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন বিপুল ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য দেশে ঢুকছে। চট্টগ্রামে অনলাইনেও মাদক বেচাকেনা জমজমাট।
নারায়ণগঞ্জ শহরেই ২০ হাট : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি রাশেদুল ইসলাম রাজু জানান, শুধু নারায়ণগঞ্জ শহরেই মাদকের কমপক্ষে ২০টি হাট রয়েছে। ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক এসব হাট ছাড়াও ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের কাছ থেকে তরুণদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মূলত ঢাকার পাশে হওয়ায় এবং বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত থাকায় এই শহরে মাদকের সহজলভ্যতা বেশি। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে বিভিন্ন বাসেও এ শহরে পৌঁছছে মাদক। শহরের চাষাঢ়া ও ২ নম্বর রেলস্টেশন, গলাচিপা, উকিলপাড়া রেললাইন, জামতলা, জিমখানা বস্তি, আমলাপাড়া, মাসদাইর, ইসদাইর, বাবুরাইলসহ কমপক্ষে ২০টি স্থানে বসে মাদকের হাট। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সদর থানা এলাকায় তালিকাভুক্ত ২১ জন, ফতুল্লায় ৪১ জন, বন্দর থানা এলাকায় ৩১ জনসহ জেলায় দুই শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। মাদককে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনাও ঘটছে। যেমন—গত ৩১ মার্চ সদর উপজেলার ফতুল্লার কাশিপুরে মাদকের টাকার লেনদেন নিয়ে মো. পাভেল (৩৩) নামের এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
সাভার-আশুলিয়ায় ব্যবসা রমরমা : সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি ওমর ফারুক জানান, সাভার-আশুলিয়ায় খুচরা মাদক ব্যবসায়ী হাজারের বেশি। মাদক বিক্রি করা হয় তিন শতাধিক স্থানে। আছেন বহু ভ্রাম্যমাণ মাদক ব্যবসায়ী। প্রতিটি মাদক কারবারির আছে ৩০ থেকে ৫০ জনের বেতনভুক্ত বাহিনী। অবস্থা এমন যে সম্প্রতি আশুলিয়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধসহ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে এলাকাবাসী। আশুলিয়ার পাথালিয়া ইউনিয়নের খেজুরটেকের কোরবান আলীর ছেলে মজিবর রহমান এবং তাঁর ছেলে সামিউল আলম সৈকত মাদক কারবার চালিয়ে আসছেন। তাঁরা এলাকায় ৩৫ জন ডিলার নিয়োগ করেছেন। খেজুরটেকের বাসিন্দা ক্যাপ্টেন (অব.) রমজান বলেন, ১৮ বছর ধরে এলাকায় মাদক কারবারের কারণে বসবাস করার মতো অবস্থা নেই।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি সোনিয়া হাবিব লাবনী জানান, জেলার ছয়টি উপজেলায় মাদক কারবার জমজমাট। জেলার বিভিন্ন পরিত্যক্ত ভবন, বসতবাড়ি, ফসলি জমির আইল, হাটবাজার, বাগান কিংবা নির্জন স্থানগুলোয় মাদক বিক্রি চলছে। জেলার ৬৮ ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে একাধিক মাদক বিক্রির চক্র। এগুলো কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে বাণিজ্য চালাচ্ছে। জেলা সদরের মালপাড়া, জমিদারপাড়া, উত্তর ইসলামপুর, মাঠপাড়া, কোর্টগাঁও, কাটাখালি, মানিকপুর, নতুনগাঁও, পঞ্চসার জিয়সতলা, নয়াগাঁও বাস্তুহারা, হাটলক্ষ্মীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে মাদক ব্যবসা চলছে।
সিলেটে অনলাইনে : সিলেট থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক ইয়াহইয়া ফজল জানান, হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারের কল বা মেসেজে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যায় মাদক। ব্যবসায় ৯০ শতাংশ লেনদেন এখন ক্যাশলেস। সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্তপথে ইয়াবা ও ফেনসিডিল আসছে ভারত থেকে। অন্যান্য মাদক ঢুকছে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত দিয়ে। নগরের কাস্টঘর এলাকায় গাঁজা ও বাংলা মদ বিক্রি করছেন নারীরাও। সালুটিকর সেতুর আশপাশ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে সীমান্তপথে ভারত থেকে ফেনসিডিল আসছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় সিলেটের প্রসিকিউটর মো. জীবন মাহমুদ বলেন, ‘সিলেটে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলের প্রভাব বেশি। আমরা নিয়মিত প্রায় প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছি।’
নরসিংদীতে পুলিশও জড়িত : নরসিংদী প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান জানান, রেল, নৌ ও সড়কপথে আখাউড়া, ভৈরব, কুমিল্লা, টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক ঢুকছে নরসিংদীতে। জেলার প্রায় সর্বত্রই মিলছে ইয়াবা বড়ি। রাজনৈতিক নেতা, রেল, থানা ও গোয়েন্দা পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও মাদক পাচারে জড়িত। শিবপুরের সৃষ্টিগড় থেকে উদ্ধার হওয়া ৯৬ কেজি গাঁজা এক মাদক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির অভিযোগে গত ১৫ মার্চ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান এবং জেলা জজ আদালতের ইন্সপেক্টর খন্দকার জাকির হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়।
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ছে : বিভিন্ন স্থানে যৌথ বাহিনীর অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়ছেন। তাতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় শান্তি ফিরছে। যেমন—গত শুক্রবার নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পাঁচগ্রাম ইউনিয়নের মহিষখোলা ও যাদবপুরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথ অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীসহ তিনজনকে আটক করে। তাঁরা হচ্ছেন আকাশ মোল্লা, আলী শেখ ও হায়দার ভূইয়া। অভিযানে তাঁদের কাছ থেকে গাঁজা, ইয়াবা এবং ইয়াবা ও গাঁজা সেবনের বিভিন্ন সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের পেকুয়ায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ী সানাউল্ল্যাহ বাহাদুরকে (৪৮) গ্রেপ্তার করেছে। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৩৪টি ইয়াবা।