Image description
রাজধানীতে ৫ মাসে ১৬৮ খুনের মামলা

রাজধানীর বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ২৫ মে রাতে সংঘটিত ওই হত্যাকাণ্ডে এখনো কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্বজনদের দাবি, রাজনৈতিক কারণে হত্যা করা হয়েছে বিএনপির এ নেতাকে। এর আগে গত ১৯ এপ্রিল রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন নয়াটোলা মোড়ল গলিতে গুলিবিদ্ধ হন মতিঝিল থানার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য মো. আরিফ সিকদার। ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে দুদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে মারা যান তিনি। একই দিনে তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে রাজধানীর বনানীতে খুন হন ছাত্রদলকর্মী পারভেজ।

শুধু এই তিনটি হত্যাকাণ্ডই নয়, গত পাঁচ মাসে রাজধানীতে ১৬৮টি হত্যা মামলা রেকর্ড হয়েছে; যার ৩৯ শতাংশই রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। আর এই রাজনৈতিক প্রভাব কেন্দ্র করে পূর্ব বিরোধ, এলাকায় আধিপত্য সৃষ্টি, চাঁদাবাজি এবং বৈধ-অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। অনেক হত্যাকাণ্ডে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কিলার ভাড়া করা হচ্ছে। আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও জড়িয়ে পড়েছে এসব ‘কিলিং বাণিজ্যে’।

অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক মুহাম্মদ আব্দুল কাদের মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকার যদি কঠোর হয় এবং পুলিশ কাজ করার ক্ষেত্রে আরও সাহসী ভূমিকা নিতে পারে তাহলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কমে আসবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড থামাতে প্রয়োজন সুশাসনভিত্তিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা। রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সঠিক সময়ে নির্বাচনেরও দরকার। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার গঠিত হলে এগুলো কমে আসবে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম বিভাগের এক সহকারী কমিশনার (এসি) যুগান্তরকে বলেছেন, ‘এলাকার আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে কোনো কোনো রাজনৈতিক পক্ষ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। টার্গেট করে বিরোধী পক্ষের লোকদের হামলা ও খুন করা হচ্ছে। এছাড়া গুরুতর জখমের ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে।’

নিউমার্কেট ও ধানমন্ডি এলাকার উদাহরণ দিয়ে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই এলাকায় শীর্ষসন্ত্রাসী ইমনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে একটি পক্ষ। সর্বশেষ ১৮ মে রাজধানীর নিউমার্কেট থানাধীন সেন্ট্রাল রোডে কলাবাগান ওয়ার্ড বিএনপির কর্মী সাইফ হোসেন মুন্নাকে কুপিয়ে গুরুতর জখমের পেছনে হাত রয়েছে ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের।’

রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় এমন হামলা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। কেউ মারা গেলেই বিষয়টি আলোচনায় আসছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চরম আতঙ্কে আছেন রাজধানীবাসী। তবে ডিএমপির শীর্ষ কর্তারা বলছেন, রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে নিহতের ঘটনায় এখনো মামলা নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে হত্যা মামলার সংখ্যা বেড়েছে।

ডিএমপির পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীর মোট ৫০টি থানা এলাকায় গত পাঁচ মাসে ১৬৮টি হত্যা মামলা রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬টি হত্যাকাণ্ডই রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় রেকর্ড হওয়া ৩৬টি মামলার মধ্যে ১৬টিই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৮টি মামলার মধ্যে ১৬টিই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। মার্চে ৩৩টি মামলার ১৬টিই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এপ্রিলে ২৯টি মামলার ৯টিই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। মে মাসের ৩২টি মামলার মধ্যে ৯টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।

জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘বড় শহর, অনেক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। ১৭ বছর টানা এক ধরনের শাসনব্যবস্থা ছিল। এখন নতুন করে আরেকটা শাসনব্যবস্থা চলছে। তবে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণেই আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মামলা এখনো রেকর্ড হচ্ছে। এ কারণে মামলার সংখ্যা বেড়েছে।’

উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে চাঞ্চল্যকর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে হত্যা। সূত্র বলছে, কামরুল হত্যার নেপথ্যে ছিল পূর্ববিরোধ ও এলাকার আধিপত্য। এ হত্যায় আন্ডার ওয়ার্ল্ডের গডফাদারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিশেষ করে গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে তোলা চাঁদার টাকা নিয়েই ঘটে বিপত্তি।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দুই আসামিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে তারা ওই এলাকার না। ধারণা করা হচ্ছে, তারা (খুনিরা) ভাড়াটে কিলার।’

এছাড়া রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন নয়াটোলা মোড়ল গলিতে গুলিবিদ্ধ হন মতিঝিল থানার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য মো. আরিফ সিকদার। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ এপ্রিল মারা যান তিনি।

গত ২ মে আরিফ হত্যা মামলায় প্রধান অভিযুক্ত ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ‘শুটার’ মাহফুজুর রহমান বিপুকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বিপু পর্দার আড়াল থেকে হত্যার কলকাঠি নেড়েছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দারা।

র‌্যাব জানায়, বিপু শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং তার একটি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। রাজধানীর মগবাজার ও হাতিরঝিল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল বিপু।

এ হত্যার ঘটনায় আরিফ সিকদারের বোন রিমা আক্তার বাদী হয়ে মাহফুজুর রহমান বিপুসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। জানতে চাইলে ডিবি তেজগাঁও বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ রাকিব খান যুগান্তরকে বলেন, ‘আরিফ সিকদার হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত আমরা পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছি। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে।’

গোয়েন্দাদের ইনভেস্টিগেশন বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিমেন্ট বালুর ব্যবসাসংক্রান্ত এলাকার আধিপত্য নিয়ে আরিফ সিকদারের সঙ্গে বিএনপির অপরপক্ষের ঝামেলা চলছিল। ঘটনার সময় আরিফ সিকদারকে গুলি করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ইয়াসিন।