Image description

এইচএসসি ও সমমানের চলতি বছরের (২০২৫) পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে আগামী ২৬ জুন থেকে। যাতে অংশ নেবে ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার নিয়মিত শিক্ষার্থী, যারা ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। ওই বছর উত্তীর্ণ প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না, যা মোট শিক্ষার্থীর ৩৬ শতাংশ। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়াকে উদ্বেগজনক মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছিল। তাদের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে (একাদশ, আলিম, ভোকেশনাল একাদশ) ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮৯ জন রেজিস্ট্রেশন করেছে। এর অর্থ, এসএসসি পাস করার পর ১ লাখ ৫৭ হাজার ২৫১ জন শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিই হয়নি, যা ভর্তি পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এ ছাড়া একাদশ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করার পরও চূড়ান্ত এইচএসসি পরীক্ষার জন্য মাত্র ১০ লাখ ৫০ হাজার ২৮৫ জন ফরম পূরণ করেছে। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন করেও ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৩০৪ জন (২১ দশমিক ০২ শতাংশ) শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না।

সব মিলিয়ে, এসএসসি পাসের পর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত মোট ৫ লাখ ৯০ হাজার ৭৫৫ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, যা মোট শিক্ষার্থীর (পাস করা) ৩৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এমনকি ফরম পূরণ করার পরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে।

শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্টরা এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়াকে দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। এর পেছনে দারিদ্র্য, বাল্যবিয়ে, মেয়েদের নিরাপত্তা, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, পারিবারিক চাপ, কর্মে প্রবেশ, পড়ালেখায় অনাগ্রহ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি, কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণ জড়িত থাকতে পারে। এই প্রবণতা দেশে উচ্চশিক্ষার হার এবং দক্ষ জনবল তৈরিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

বোর্ডভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেশি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ঝরে পড়ার হার সর্বোচ্চ ৩৯.৯৬ শতাংশ। এর পরই রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, যেখানে ঝরে পড়ার হার ৩৮.৬৪ শতাংশ। আর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ১৫.৯৪ শতাংশ। ৯টি সাধারণ বোর্ডে ২০২৩ সালে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬৭ জন। তাদের মধ্যে ফরম পূরণ করেছে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৮ জন। ৩ লাখ ২০ হাজার ৫৬৯ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। মাদ্রাসা বোর্ডে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১ লাখ ২৮ হাজার ৭৫৯ জন, তাদের মধ্যে পরীক্ষায় বসছে ৭৯ হাজার ৯ জন। ফরম পূরণ করেনি ৪৯ হাজার ৭৫০ জন। কারিগরি বোর্ড রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬৩ জন। তাদের মধ্যে ফরম পূরণ করেছে ৯৫ হাজার ৪৩৮ জন। ফরম পূরণের বাইরে রয়েছে ৬৩ হাজার ৫২৫ জন।

কোন বোর্ডে কতজন ঝরে পড়ল: বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা বোর্ডে একাদশ শ্রেণিতে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৪৪৬ জন রেজিস্ট্রেশন করলেও পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ২৩৫ জন। ঝরে পড়েছে ৭৮ হাজার ৬৭৩ জন। একইভাবে রাজশাহী বোর্ডে ৬১ হাজার ২৫৭ জন, কুমিল্লায় ৪৪ হাজার ১১৬ জন, যশোর বোর্ডে ৩৭হাজার ৯৫৯ জন, চট্টগ্রামে ২৮ হাজার ৩৭৪ জন, বরিশালে ১৯ হাজার ৬২৭ জন, সিলেটে ১৮ হাজার ৮২১ জন, দিনাজপুরে ৩৫ হাজার ৭৬৯ জন, ময়মনসিংহে ২১ হাজার ৪১৮ জন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ৪৯ হাজার ৭৫০ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৬৩ হাজার ৫২৫ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।

এবার পরীক্ষার্থী কমেছে ৮১ হাজার: আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্র ৬ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন ও ছাত্রী ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬ জন। গত বছর এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৯৩ পরীক্ষার্থী। সে অনুযায়ী, এ বছর পরীক্ষার্থী কমেছে ৮১ হাজার ৮৮২ জন।

অনিয়মিত পরীক্ষার্থী ২ লাখ: গত শিক্ষাবর্ষে (২০২৪) এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এক থেকে একাধিক বিষয়ে ফেল করেছিল—এমন পরীক্ষার্থী ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭০ জন। এ ছাড়া মানোন্নয়নের জন্য নতুন করে পরীক্ষায় বসবে—এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ হাজার ৩৬৫ জন। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ২ লাখ ৭২৬ জন। এক বিষয়ের পরীক্ষা দেবে—এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ জন, দুই বিষয়ে ৩৫ হাজার ৩৬২ জন। সব বিষয়ে পরীক্ষা দেবে ৩৬ হাজার ৪৫০ জন।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির কালবেলাকে বলেন, ‘ঝরে পড়ার প্রকৃত চিত্র জানার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনলাইনে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বাল্যবিয়ে এবং কর্মজীবনে প্রবেশের কারণে অনেকেই একাদশ শ্রেণিতে উঠে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হওয়া এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার মতো বিষয়গুলোও উদ্বেগজনকভাবে উঠে এসেছে।’

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার জানান, মাঠ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এতদিন ঝরে পড়ার হারে মেয়েরা এগিয়ে থাকলেও বর্তমানে ছেলেদের সংখ্যাও বাড়ছে। তাদের কাছে এমন তথ্যও আছে যে, এসএসসি পাস করার পর শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও বিয়ে করছে এবং সংসারের হাল ধরছে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বোর্ড থেকে আগে কখনো এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি না হলেও আমরা প্রথমবারের মতো ঝরে পড়ার হার ও কারণ বের করে প্রতিবেদন সুপারিশ আকারে সরকারকে জানাব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ গবেষক ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পেছনে প্রতিটি পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকলেও সামগ্রিকভাবে এই হার উদ্বেগজনক। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বারবার কারিকুলাম পরিবর্তন এবং কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার অভাব। এর ফলে অভিভাবক ও তরুণদের মধ্যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বিমুখতা বাড়ছে। এ ছাড়া ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির উদাসীনতা, ক্ষমতা ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় শিক্ষার মানের দিকে মনোযোগ কম।

তৌহিদুল হক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার চিত্রটা উদ্বেগজনক। এটি শুধু সমাজ নয়, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। সরকারকে কথিত জনপ্রিয়তার পেছনে না ছুটে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং যোগাযোগ বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা।