Image description
সংসদ নির্বাচনের সময়

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে কারও কথাই রইল না। গতকাল শুক্রবার লন্ডনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকের পর যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়ার মতো এক নিমেষেই বদলে গেছে রাজনীতির দৃশ্যপট। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দল, সরকারসহ বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে নানা কথা ও দাবি-দাওয়া শোনা যাচ্ছিল। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা চলতি বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ছিল অনড়। গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যে কোনো দিন নির্বাচন হবে। তার আগে তিনি জুনের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথাও বলেছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বরাবরই বলে আসছিলেন প্রয়োজনীয় সংস্কার ও গণহত্যার বিচার শেষে নির্বাচন আয়োজনের কথা। সেক্ষেত্রে জুন, এপ্রিল বা রোজার আগে যে কোনো সময় হতে পারে বলে মত ছিল তাদের। নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, গণপরিষদ, গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের দাবিতে অনড় রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত বলে জানিয়েছিলেন।

কিন্তু শুক্রবার লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে ক্যারিশমেটিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আগামী রোজার আগে নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সভা শেষে যৌথ বিবৃতি থেকে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। যৌথ বিবৃতির পরই চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে ঐতিহাসিক এ বৈঠকের পর দ্রুতই পাল্টে যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে আগে যে যত কথাই বলেছেন কোনোটাই আর রইল না। রোজার আগের সপ্তাহে নির্বাচন হবে, এমনটাই নিশ্চিত হয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আলোচনা চলছে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম রোজা শুরু হবে। তার আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথামার্ধে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

লন্ডনে ইউনূস-তারেক বৈঠক শেষে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান জানিয়েছেন ‘শিগগির নির্বাচন কমিশন তারিখ ঘোষণা করবে।’ এরই মধ্যে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্র জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নির্বাচন হতে পারে। এই সময়ে নির্বাচন আয়োজনে সরকার সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার গুলশানে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। তিনি ইউনূস-তারেক বৈঠককে সফল হিসেবে আখ্যায়িত করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

জানা গেছে, রোজার আগে নির্বাচন করতে হলে তার কয়েকদিন আগেই ভোট গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে রোজার আগের সপ্তাহে ভোটের সম্ভাব্য তারিখ দেওয়া হতে পারে। লন্ডনে ইউনূস-তারেক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, নির্বাচনের একটি সঠিক তারিখ নির্ধারণে সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ‘কোনো সমস্যাই নেই। আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না, কেউ দেখলে এটা ভুল দেখছেন। নির্বাচন সম্পর্কে আজকে যৌথ বিবৃতিতে আমরা বলে দিয়েছি। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’

লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের পর সন্তোষ প্রকাশ করে বিএনপি প্রতিক্রিয়া জানালেও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামী প্রতিক্রিয়া জানাবে।’

এদিকে লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের তীব্র সমালোচনা করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘দেশের মাটিতে নির্বাচন নিয়ে বিদেশে রাজনৈতিক বৈঠক গণআকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। লন্ডনে বসে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকার প্রধানের সভা দেশবাসীর স্বার্থ ও গণআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা। শহীদদের রক্তকে অবমাননা করে বিদেশের মাটিতে মিটিং আয়োজন কখনো মেনে নেওয়া যায় না। শুক্রবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এনসিপির এই নেতা আরও বলেন, সরকার যদি সংস্কার, গণহত্যার বিচার এবং সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হয়, তাহলে এনসিপি দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থানের দিকে যেতে বাধ্য হবে। এমনকি এই সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনে ব্যর্থ হলে এনসিপি কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না। তিনি আরও বলেন, শুধু রাজা বা রানি বদল হলেই চলে না, কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। এনসিপি বিশ্বাস করে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে।’

এনসিপির এই মুখ্য সমন্বয়ক আরও বলেন, ‘বিএনপি এক সময় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানালেও এখন রোজার আগের সময়সীমায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু তারা এখনো জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র, বিচার বা নতুন সংবিধান নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট প্রস্তাব দেয়নি। ফলে এটি বোঝা যাচ্ছে, তারা কেবল ক্ষমতার লোভে যুক্ত আছে, গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করছে না। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি একযোগে দেশের জনগণকে পাশ কাটিয়ে দেশে একটি গভীর সংকট তৈরি করছে। জনগণ অতীতেও লড়াই করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সরকারই বৈধ হতে পারে না। শুধু নির্বাচন করলেই হবে না, সঠিক বিচার ও সাংবিধানিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের অর্থ নেই। এখনকার নির্বাচন কমিশন জনগণের আস্থার প্রতীক নয় বরং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে কাজ করছে। তাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, আরপিও সংশোধন এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন না হলে দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব নয়।’

অন্যদিকে বিশ্লেষক মহল বলছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা বা রোডম্যাপ নিয়ে যেসব অনিশ্চয়তা ছিল সেটা কেটে গেছে। এখন সরকারের নির্দেশনা অনুসারে নির্বাচন কমিশন সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করবে। এর আগে যারাই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে যা বলেছে কোনোটাই এখন আর ধোপে টিকল না। সরকার ও বিএনপি দুপক্ষই সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে এবং নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ ছিল, সেটা দূর করেছে।

জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে শুক্রবারের বৈঠকের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির কালো ছায়া উড়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে দুই পক্ষই লাভবান হয়েছে। এই বৈঠক প্রমাণ করল, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনীতির অনেক জটিল বিষয়ও সহজে সমাধান সম্ভব। নির্বাচনের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটি সবার জন্যই কল্যাণকর। সংস্কার এবং গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগের বিচারও এই বৈঠকের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হবে। একটা ফলপ্রসূ আলোচনার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকে দেশ জোরালোভাবে ধাবিত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই বৈঠকের মাধ্যমে দেশ একটি কঠিন সংকটের হাত থেকে রেহাই পেল। রাজনীতির গুমোট হাওয়া দূর হলো। আর নির্বাচনের অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে অতীতে যে যত কথা বলেছে, সেটাও আর থাকল না।