
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে লন্ডনে গতকাল শুক্রবার বহুল আলোচিত বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর মধ্য দিয়ে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনের দীর্ঘ দেড় দশকের মধ্যে এই প্রথম কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করলেন তিনি, যা কোনো বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা ও সরকারের প্রথম বৈঠক। এমন এক সময়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক হলো, যখন নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। সেইসঙ্গে নির্বাচন, সংস্কার এবং জুলাই গণহত্যার বিচারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গতকাল অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে কূটনৈতিক মহল এবং সুশীল সমাজেও বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে। দেশ-বিদেশের প্রায় সব গণমাধ্যমের মূল খবরের অংশ হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে লন্ডনে অনুষ্ঠিত শীর্ষ দুই ব্যক্তির বৈঠক। একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের সঙ্গে সরকার প্রধানের বৈঠকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও উচ্ছ্বসিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত প্রধান উপদেষ্টার আগ্রহেই তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কেটে যাবে। সেইসঙ্গে বৈঠকটি রাজনৈতিক ইতিহাসে দৃষ্টান্ত এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। বৈঠককে ফলপ্রসূ আখ্যা দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রায় দুই ঘণ্টার ওই বৈঠক নিয়ে গোটা জাতি উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করছিল এবং বৈঠকটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে বলে সবাই মনে করছিল। আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, সত্যিকার অর্থেই এ বৈঠকটি একটা টার্নিং পয়েন্টে পরিণত হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, তারেক রহমানের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক নিঃসন্দেহে প্রতীক্ষিত। এরই মধ্যে তারেক রহমানের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতা সারা দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের মাধ্যমে তারেক রহমানের দক্ষ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা আবারও প্রমাণিত হলো।
গতকাল লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় (বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা) বৈঠকটি শুরু হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় (বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৩টা) বৈঠক শেষ হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে লন্ডনে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। তারা সকাল ৭টা থেকেই দলীয় নির্দেশনা মেনে ডরচেস্টার হোটেলের আশপাশে সমবেত হন এবং বিভিন্ন স্লোগান দেন। তারেক রহমান কালো রঙের স্যুট পরে বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টায় বাসা থেকে রওনা হয়ে একটি ধূসর রঙের জিপে করে হোটেলে পৌঁছান। গাড়ি থেকে নেমেই তিনি তাকে স্বাগত জানাতে আসা সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে করমর্দন করেন। এরপর সমবেত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করেন। লবিতে প্রবেশ করার সময় ড. ইউনূস হাসিমুখে তারেক রহমানের সঙ্গে করমর্দন এবং কুশল বিনিময় করেন। দেড় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা বৈঠক শেষে গাড়িতে উঠেই তারেক রহমান প্রথম টেলিফোনে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈঠকে সংস্কার প্রক্রিয়া এবং অতীতে সংঘটিত ছাত্র ও যুবক হত্যা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচার এবং দেশের বন্দর, করিডোরসহ নানা প্রসঙ্গও আলোচনায় উঠে এসেছে। এ আলোচনা এবং এর সম্ভাব্য বাস্তবায়ন দেশের রাজনৈতিক শুদ্ধীকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশাবাদী হওয়া যায়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু কালবেলাকে বলেন, ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হলো। দেশের মানুষ ভাবছিল দেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকটি খুবই জরুরি। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিচক্ষণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে দুই শীর্ষ ব্যক্তির মধ্যে অভূতপূর্ব আলোচনা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশ এবং জাতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করল। এখন সবাইকে সচেতন থাকতে হবে, কোনো ষড়যন্ত্রকারী যাতে এটি বিনষ্ট করতে না পারে। কারণ, এ আলোচনার সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত না হলে দেশ ও জাতি যে খাদে পড়বে, তাতে বাংলাদেশ আর কোনোদিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
‘আমরা বিএনপি পরিবার’-এর আহ্বায়ক আতিকুর রহমান রুম্মন কালবেলাকে বলেন, চতুর্দিকে একটা অনিশ্চয়তা ছিল। অনেকে অনেক কথা বলছিলেন। আজকে (গতকাল) দুই নেতা প্রমাণ করলেন, বাংলাদেশের মানুষ এখনো প্রয়োজনের সময়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং নেতারা নেতৃত্ব দিতে পারেন। এই বৈঠকের জন্য প্রথমেই কৃতিত্ব দেব, গত ১৫ বছরে আমাদের দলের যেসব নেতাকর্মী গুম-খুন হয়েছেন তাদের। এরপর চব্বিশের আন্দোলনে যেসব ছাত্র-তরুণ-যুবক শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন তাদের। এরপর গণতন্ত্রের মাতা খালেদা জিয়াকে কৃতজ্ঞতা জানাই যিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে নিজের জীবনকে বাজি রেখেছেন। তার কী অবস্থা সবাই জানেন। এরপর কৃতিত্ব দেব বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে, যিনি লন্ডনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। শত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত সত্ত্বেও এতদূর থেকেও তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আতিকুর রহমান রুম্মন বলেন, বৈঠকের মাধ্যমে শুধু তারেক রহমান সফল নন, এটি দেশের সফলতা, গণতন্ত্রের সফলতা ও জাতীয়তাবাদী দলের সফলতা।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, এই প্রজন্ম দেখল জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান। আর শীর্ষ দুই নেতা ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের একান্ত বৈঠক হলো গঠনমূলক সমাধান, যা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয়। আমরা উদ্বেলিত, কারণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে বৈঠকটি করেছেন। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ও আগামীর কল্যাণমূলক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শীর্ষ দুই নেতার আন্তরিক প্রচেষ্টা অবশ্যই সফল হবে।
২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময় কারামুক্ত হয়ে সপরিবারে লন্ডনে চলে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের সময়ে তার অনুপস্থিতিতে পাঁচ মামলায় তাকে সাজা দেওয়া হয়। দায়ের করা হয় শতাধিক মামলা। আদালতের চোখে তিনি হয়ে যান ‘পলাতক আসামি’। এমনকি আওয়ামী লীগের সরকার সময়ে তার বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারেক রহমানকে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়। ২০১৫ সালে ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু আর মায়ের কারাগারে যাওয়ার মতো দুঃসময়েও তার দেশে ফেরা হয়নি।
একপর্যায়ে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। যেসব মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল, একে একে তার সবগুলোতেই খালাস পান খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। মুক্ত খালেদা এ বছরই চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়ে প্রায় চার মাস পর ঘুরে এসেছেন। সেখানে ছেলের বাসাতেই তিনি ছিলেন। তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানও ১৭ বছর পর গত ৬ মে শাশুড়ির সঙ্গে দেশে ফেরেন। গত ৫ মে তিনি যুক্তরাজ্যে ফিরে গেছেন। কিন্তু তারেক রহমান কবে ফিরবেন, তার উত্তর বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা পরিষ্কার করে বলতে পারছেন না। শুধু বলছেন শিগগিরই ফিরবেন তারেক রহমান। তারা বলে আসছেন, ‘সময় হলেই’ তারেক রহমান ফিরবেন। আর দেশে না থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তিনিই দল চালাচ্ছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নিয়মিত বৈঠক করছেন।