Image description

গত ৫ই আগস্টের মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ঘটনা। ৫০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। এই দৃশ্য যে কারও অন্তরে কাঁপন ধরাবে। যেখানে কলেজপড়ুয়া একটি ছেলেকে ধরে আছে কয়েকজন পুলিশ সদস্য। চড়-থাপ্পড়, কিল- ঘুষি মারছে। কেউ কেউ আবার কলার ধরে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। একটু দূর থেকেই দৌড়ে এলো এক পুলিশ সদস্য। কাছে এসেই কলেজ শিক্ষার্থী হৃদয়ের পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দিলো। গুলির বিকট শব্দ। মাত্র ৩ সেকেন্ডেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হৃদয়। ছটফট করে হাত-পা নাড়তে থাকেন। দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। তবে পারেননি। একটু পরেই নিথর হয়ে যায় মাটিতে পড়ে থাকা হৃদয়ের দেহ। স্রোতের বেগে রক্ত বের হতে থাকে। অল্প সময়ে রাস্তা লাল হয়ে যায়। পরনের কাপড় ভিজে যায়। গুলি করেই পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে সরে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার তারা হৃদয়ের কাছে ফিরে আসে। এসে নিথর দেহ পা দিয়ে ঠেলে দেখতে থাকে মৃত্যু হয়েছে কি না। পরে ৪জন পুলিশ সদস্য মিলে হৃদয়ের গুলিবিদ্ধ মরদেহ হাত-পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে দূরে কোথায় নিয়ে যান। কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো হৃদয়ের মৃতদেহ? কেউ জানে না এখনো। 

নিহত হৃদয়ের লাশ তার স্বজনদের  ফেরত দেয়নি পুলিশ। লাশ কোথায় রাখা হয়েছে। দাফন করা হয়েছে নাকি ফেলে দেয়া হয়েছে, তা এখনো জানতে পারেনি হৃদয়ের পরিবার। হৃদয়ের নিহতের ঘটনার একটি ভিডিও গত ৩০শে আগস্ট ভাইরাল হয়। এতে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। গাজীপুর কোনাবাড়ী থানা রোডে শরীফ মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তার ওপরে ৫ই আগস্ট বিকাল ৫টার দিকে পুলিশের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে বিপাকে পড়ে পুলিশ। গুলি ছোড়া পুলিশ কনস্টেবল আকরামের নামও প্রকাশ্যে চলে আসে। পরে চাকরি থেকে পালিয়ে কনস্টেবল আকরাম হোসেন নিজ গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার বরুহাতে চলে যায়। গত ৬ই সেপ্টেম্বর আকরামকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে এই মামলার এজহারনামীয়  আসামি দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তারের পর মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য আসামি আকরামের ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। তবে আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপরে অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে যায়। যা আর প্রকাশ্যে আসেনি। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা উৎপল কুমার সাহার দেয়া এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাইরাল হওয়া ভিডিও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কনস্টেবল আকরাম হোসেন তার ব্যবহৃত শটগান দিয়ে ভিকটিম হৃদয়কে পেছন দিক থেকে গুলি করে মাটিতে ফেলে দেয়। এতে ঘটনার সঙ্গে আকরামের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য কনস্টেবল আকরামকে কারাগারে রাখা ও জামিন না দেয়ার জন্য আদালতে অনুরোধ করা হয়। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত ২৩শে ডিসেম্বর গাজীপুর দায়রা জজ আদালতের অবকাশকালীন বিচারক প্রধান অভিযুক্ত আকরামকে জামিন দেন। রাতেই কারাগার থেকে বেরিয়ে যান আকরাম। এতে অবাক হয় পুলিশও। সূত্র বলছে, জামিনে বেরিয়েই গা ঢাকা দিয়েছেন পুলিশ কনস্টেবল আকরাম হোসেন। আকরামের গ্রামের বাড়ির একটি সূত্রে জানা গেছে, জামিনের পরে  সে আর বাড়িতে ফেরেনি। পরিবারের সদস্য ছাড়া কারও সঙ্গে যোগাযোগও রাখছে না আকরাম। তবে সে ২৬শে ডিসেম্বর দেশ ছেড়েছে বলে ওই সূত্র দাবি করেছেন। 
হৃদয়ের লাশ কোথায়: অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুলি করে হত্যার পর হৃদয়ের মৃতদেহ প্রথমে শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ এর ২০জন কনস্টেবল, কোনাবাড়ী থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশ সদস্যরা টেনে-হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে লাশ রেখেই পালিয়ে যায় শিল্পাঞ্চল পুলিশের সদস্যরা। পরে হাজার হাজার মানুষ বিজয় মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে এলে ভয়ে অধিকাংশ পুলিশ সদস্য থানা ছেড়ে পালাতে থাকে। থানায় নেয়া লাশ পরে কোথায় কীভাবে রাখা হয় তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। 

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, নিহত হৃদয় টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি টাঙ্গাইল হেমনগর ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। অভাবের সংসারের হাল ধরতেই তিনি গাজীপুরে এসে অটোরিকশা চালাতেন। গত ৬ই আগস্ট থেকেই গাজীপুরের বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে খুঁজেও হৃদয়ের লাশের সন্ধান পায়নি পরিবার। পরে ৭ই আগস্ট থানায় গিয়ে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখতে পায়নি পরিবারের লোকজন। মূলত ৫ই আগস্ট থেকে ১৬ই আগস্ট পর্যন্ত পুলিশশূন্য ছিল কোনাবাড়ী থানা। এতে গুলিতে নিহত হৃদয়ের লাশের সন্ধান পেতে বারবার থানায় এসেও কোনো পুলিশ সদস্যকে পায়নি পরিবার। এরমধ্যে নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে পুলিশে ব্যাপক রদবদল করা হয়। কোনাবাড়ী থানায় ৫ই আগস্টের আগে কর্মরত পুলিশের অধিকাংশ সদস্যকেই অন্যত্র বদলি করা হয়। এতে হৃদয়ের লাশ কোথায় রাখা হয়- সেই প্রশ্নের উত্তর আজও পায়নি পরিবার। এখনো ছেলের লাশের অপেক্ষায় পুলিশের কাছে ধরনা দিচ্ছেন হৃদয়ের পরিবার। সরজমিন কোনাবাড়ী থানা এলাকায় গিয়ে এই বিষয়ে স্থানীয়দের কাছে খোঁজ-খবর নেয়া হয়। জানার চেষ্টা করা হয় গুলিতে নিহত হৃদয়ের মরদেহ কোথায় লুকিয়ে রাখে থানা পুলিশ। এতদিন পার হলেও লাশের সন্ধান মিলছে না কেন? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কোনাবাড়ী থানা রোডের এক ব্যক্তি মানবজমিনকে বলেন, সেদিন বিকাল থেকে থানা ও আশপাশের এলাকা থমথমে ছিল। মানুষ থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে। পুলিশ শত শত রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। গুলির শব্দে থানার আশপাশে কোনো মানুষ ভিড়তে পারেনি। সন্ধ্যার দিকে চার হাত-পা ধরে ঝুলিয়ে একটি লাশ থানায় নিয়ে আসে কয়েকজন পুলিশ সদস্য। থানার সামনে এনে পুলিশ ভ্যানে রাখা হয়। পরে সাড়ে ৬ টার দিকে পুলিশ ভ্যানে করে ওই লাশটি থানা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় নেয়া হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। 

এদিকে ২৬শে আগস্ট হৃদয়ের পরিবারের করা হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান কোনাবাড়ী থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক উৎপল কুমার সাহা। জানতে চাওয়া হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমি দায়িত্ব পাওয়ার পরে হৃদয়ের লাশ অনেক খুঁজেছি। গাজীপুরের প্রায় প্রতিটি কবরস্থানে এবং হাসপাতালের ডাটা সংগ্রহ করেছি। তবে হৃদয়ের লাশের কোনো সন্ধান পাইনি। মামলাটি পরে থানা থেকে সরিয়ে ডিবিকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। ডিবি কি তদন্ত করেছে তা আমার জানা নেই। আমি প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। শুনেছি সে আদালত থেকে জামিন পেয়ে বেরিয়ে গেছে। জামিন দেয়া আদালতের বিষয়। কীভাবে জামিন হলো- তা আদালতই ভালো বলতে পারবেন। 

ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতারা: ৪ঠা আগস্ট সকাল থেকেই উত্তপ্ত ছিল কোনাবাড়ী এলাকা। গার্মেন্টস শিল্প এলাকা হওয়ায় সকাল থেকেই পোশাক শ্রমিকরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ফলে পরদিন ৫ই আগস্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ কোনাবাড়ী সাব-ক্যাম্প থেকে পুলিশের ২০জন অতিরিক্ত ফোর্স আনা হয়। সেদিন পুরো কোনাবাড়ী থানা এলাকার নেতৃত্ব দিয়েছেন গাজীপুর মেট্‌্েরাপলিটন পুলিশ উত্তরের উপ-পুলিশ কমিশনার আবু তোরাব মোহাম্মদ শামছুর রহমান ও  কোনাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি কেএম আশরাফ উদ্দিন। জানা গেছে, ওসি ও ডিসি’র নির্দেশেই ছাত্র-জনতার ওপর চড়াও হয় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। পরবর্তীতে হৃদয়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যাকারী পুলিশ কনস্টেবল আকরাম হোসেন কারাগার থেকে হত্যা মামলায় অব্যাহতি চেয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরাবর পাঠানো একটি লিখিত আবেদনেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। সেই চিঠিতে কনস্টেবল আকরাম হোসেন পুলিশের ঊর্ধ্বতনের নির্দেশেই গুলি করেছে বলে উল্লেখ করেন। চিঠিতে তিনি বলেন, গত ৪ঠা আগস্ট শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ এর অধীনে তাকে কোনাবাড়ী সাব-জোনে বদলি করা হয়। কোনারাড়ীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ গাজীপুর ডিউটির জন্য তিনি সহ একজন এএসআই ও ১০জন কনস্টেবলকে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে কনস্টেবল আকরাম দাবি করে, তার নামে ইস্যুকৃত শটগানে ২০ রাউন্ড গুলি ছিল। ডিউটি শেষে  সে সেই ২০ রাউন্ড গুলি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়। এছাড়া তিনি আরও বলে, ৫ই আগস্ট রাতেই সে ছুটিতে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। পরে বাড়ি থেকে তাকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি বলেন, আমি উপর মহলের নির্দেশ পালন করেছি। উক্ত ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাই তিনি এই মামলা থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। তবে ঘটনার পরেই  কোনাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি কেএম আশরাফ উদ্দিনকে জিএমপি গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তর বিভাগে বদলি করা হয়। গত ৯ই আগস্ট তাকে বদলি করা হয়। এছাড়া গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) অপরাধ (গাজীপুর উত্তর) আবু তোরাব মোহাম্মদ শামছুর রহমানকে উপ-পুলিশ কমিশনার ডিবি (উত্তর) বিভাগে বদলি করা হয়। গত ১৪ই আগস্ট তাকে বদলি করা হয়। 

মামলা নিয়েও পুলিশের ছলচাতুরী: হৃদয় হত্যার ঘটনায় ২৬শে আগস্ট কোনাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন হৃদয়ের ফুফাতো ভাই মো. ইব্রাহিম। মামলা নং-০৮(৮)২৪। তবে ওই মামলায় হৃদয়ের হত্যাকারী হিসেবে গাজীপুরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়। মামলা থেকে বাদ দেয়া হয় মূল অভিযুক্ত ও গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের। এ বিষয়ে মামলার বাদী ইব্রাহিম মানবজমিনকে বলেন, আমি মামলা করতে গেলে পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে চায়নি। দুইদিন ঘুরেছি পুলিশ মামলা নিতে রাজি হয়নি। তারা আদালতে যেতে বলে। পরে ৩দিন ঘোরার পরে ওসি আমাকে পুলিশের নাম বাদ দিয়ে এজাহার লিখতে বলেন। মামলায় পুলিশকে আসামি করা যাবে না- এই শর্তে ওসি মামলা গ্রহণ করেন। তখনো আমার সন্দেহ মনে হয়েছে। আমার ভাইয়ের হত্যা ও লাশ গুমের সঙ্গে এই ওসি জড়িত ছিলেন। আমার ভাইকে পুলিশ মেরেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। তারপরও ওসি কেন পুলিশকে আসামি করতে দিলো না। 

৪ থেকে ৫ই আগস্ট যারা দায়িত্বে ছিলেন: আন্দোলনের মধ্যে ৪ থেকে ৫ই আগস্ট শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২  কোনাবাড়ী সাব-ক্যাম্প থেকে আন্দোলন দমাতে ১০-২০জন পুলিশ সদস্যকে কোনাবাড়ী থানা এলাকায় আনা হয়। একজন এএসআই’র নেতৃত্বে ১৫জন পুলিশ কনস্টেবলের দায়িত্ব পালনের রোস্টার খাতা পাওয়া যায়। ওই খাতায় ডিউটিতে থাকা সকল পুলিশ সদস্যের নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে এএসআই মাজহারুল, কনস্টেবল হামিদুল, কনস্টেবল আশিক, আব্দুল্লাহ, নাদিম, শাহাদাত, শামীম, তারিকুল, নাহিদ, সাকিব, রাকিবুল, রাজন, কাউছার, নাদিম, শাকিল, নাঈম, সজীব, আকরাম, তমাল, তানভীর ও ড্রাইভার জাহিদ। তবে তানভীর ওই ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন। তবে ৪ঠা আগস্টের রোস্টার খাতায় ডিবি ডিসি উত্তর স্যারের সঙ্গে এই পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তায় থাকবেন বলে উল্লেখ করা হয়।