
প্রায় দেড় বছর ধরে স্থিতিশীল রয়েছে করোনা পরিস্থিতি। কোথাও নেই স্বাস্থ্যবিধির বাধ্যবাধকতা, নেই মাস্ক পরার প্রবণতা। এমনকি রোগী একেবারে কমে আসায় হাসপাতালগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে করোনা পরীক্ষার কিট। উদাসীনতা দেখা যায় টিকা নিতেও।
এর মধ্যেই নতুন করে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা। গত মাস থেকে ক্রমেই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পুরোনো ধরন অমিক্রনের দুটি উপধরনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটছে ভাইরাসটির। ইতোমধ্যে দেশের স্থল ও আকাশপথসহ সব প্রবেশপথে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, সংক্রমণের যে ধারা তাতে চলতি মাসের শেষ দিকেই ব্যাপক আকারে বাড়তে পারে করোনার সংক্রমণ। ঈদুল আজহায় বিপুল পরিমাণ মানুষ ঢাকা থেকে যাওয়া-আসার ফলে পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য করোনা পরীক্ষা বাড়ানোর পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ও বয়স্কদের করোনা প্রতিরোধী টিকা দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাস থেকে করোনা পরিস্থিতি দ্রুতই খারাপ হতে থাকে। এপ্রিলে যেখানে অর্ধ শতকের নিচে ছিল আক্রান্তের সংখ্যা, সেখানে মে মাসে তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৮৬ জনে দাঁড়ায়। আর চলতি জুনের প্রথম দশ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। সারা দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাড়লে রোগীর সংখ্যা আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭৬০ জন।
তবে মৃত্যুর সংখ্যা বর্তমানে খুব একটা নেই। সর্বশেষ গত ৫ জুন একজনের মৃত্যু হয়েছে ভাইরাসটিতে। এ নিয়ে প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৯ হাজার ৫০০ জন মানুষের প্রাণ কেড়েছে করোনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে আক্রান্তদের প্রায় সবাই নতুন উপধরন এক্সএফজি ও এক্সএফসি দ্বারা সংক্রমিত। দুটোই করোনার শক্তিশালী উপধরন অমিক্রনের জেএন-১ ধরনের (ভ্যারিয়েন্টের) উপধরন।
এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন ধরন এনবি ১.৮.১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ২৩ মে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, উচ্চ সংক্রমণের এই ধরনটির ক্রমেই বিস্তার ঘটছে। ১৮ মে পর্যন্ত ২২ দেশে ৬১৮ জন রোগীর দেহে এই ধরনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভারতসহ পাশের কয়েকটি দেশে ভ্রমণে সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এসব দেশে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রবেশ পথে সতর্কতা, প্রস্তুত থাকার নির্দেশ হাসপাতালগুলোকে
অমিক্রনের নতুন উপ-ধরনের সংক্রমণ বিভিন্ন দেশে বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই পরিস্থিতিতে দেশের সব স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে হেলথ স্ক্রিনিং ও নজরদারি জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি।
গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদ স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় বলা হয়, দেশে প্রবেশ পথে থার্মাল স্ক্যানার ও ডিজিটাল হ্যান্ড হেল্ড থার্মোমিটারের মাধ্যমে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে মাস্ক, গ্লাভস ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) মজুত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়াতে করোনা প্রতিরোধ সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রচার করতে হবে এবং জনগণকে ভারতসহ সংক্রমণপ্রবণ দেশগুলোতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণ না করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
একই সংক্রমণের ব্যাপকতা বাড়ায় হাসপাতালগুলোকেও প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হালিমুর রশিদ। আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে করোনা একেবারে নিম্নমুখী থাকায় তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যেহেতু নতুন করে আবারও পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে তাই হাসপাতালগুলোতে রোগী ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ভাইরাসটি প্রতিরোধে ইতোমধ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষা না হওয়ায় অনেক হাসপাতালেই টেস্ট কিটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই নতুন করে কিট কিনতে হবে।’
ঝুঁকিপূর্ণ ও বয়স্কদের আবারও টিকা দেওয়ার পরামর্শ
করোনার পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে টিকা গ্রহণের আগ্রহ কমেছে। হাতেগোনা যে কজন টিকা নিচ্ছেন প্রায় সবাই বিদেশগামী। চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত ষাটজনের মতো করোনার টিকা নিয়েছেন। নতুন করে প্রকোপ বাড়ায় আবারও গর্ভবতী, বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন রোগতত্ত্ববিদরা। সরকারও এসব ব্যক্তির আবারও টিকাদানের বিষয়ে অনেকটা সম্মত হয়েছে।
সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) সূত্রে জানা গেছে, সরকারের হাতে বর্তমানে ৩১ লাখের মতো টিকা মজুত রয়েছে। এসব টিকা ফাইজারের। এর অধিকাংশের মেয়াদ আগামী আগস্টে শেষ হয়ে যাবে বলে জানা গেছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘অমিক্রনে নতুন এই উপধরন দ্রুত ছড়াচ্ছে ঠিক, তবে রোগীকে ক্ষতি করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। এ কারণে সংক্রমণ বাড়লেও হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও মৃত্যুহার বাড়েনি। তাই উদ্বেগের কারণ নেই। তবে যে কোনো ভাইরাস যত কম ছড়ায় ততই ভালো। বেশি ছড়ালেই প্রাণঘাতী শক্তি অর্জন করা সহজ হয়। সংক্রমণের যে ধারা তাতে জুনের শেষের দিকে ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে। সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরাসহ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে টিকা দিতে হবে।’
ডা. মুশতাক হোসেন আরো বলেন, ‘করোনা টিকার কার্যকারিতা ছয় মাসের বেশি সময় থাকে না। এ জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, গর্ভবতী নারী ও বয়স্কদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওপর। তবেই পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।’