Image description


বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতি আমাদের একতা শেখায় যেখানে ঈদ আসে শুধু ধর্মীয় আনন্দ নয়, বরং ভ্রাতৃত্ববোধ, সহানুভূতি আর একতার বার্তা নিয়ে। যদিও এটি মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব, তবুও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে। ভিন্নধর্মাবলম্বীও এই উৎসবকে দেখেন ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও সহনশীলতার প্রতীক হিসেবে।

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ) এর এমনই চারজন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীর ঈদ নিয়ে তাদের ভাবনা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা শুনেছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের ডিআইইউ প্রতিনিধি নুর ইসলাম। 

ঈদ আমার চোখে উৎসবের আনন্দে ভ্রাতৃত্বের স্পর্শ

ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও আমার কাছে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবেই থাকে এক অনন্য আনন্দ, এক গভীর তাৎপর্য। ঈদ আমার দৃষ্টিতে শুধু মুসলমানদের একটি ধর্মীয় উৎসব নয়—বরং এটি একসাথে খুশি ভাগ করে নেওয়ার, হৃদয়ের বন্ধনে সবাইকে কাছে টেনে নেওয়ার এক উপলক্ষ্য।

শৈশব থেকেই দেখে এসেছি ঈদের দিন মা সেমাই রান্না করেন আর আমরা সবাই মিলে সেই সেমাই খেয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করি। আবার দুর্গাপূজায় আমাদের মুসলিম বন্ধুরা নাড়ু-লুচি খেতে আসেন ,একসঙ্গে ভাগাভাগি করি হাসি-আনন্দ। পূজোর সময় আমি যেভাবে বন্ধুদের নাড়ু খাইয়ে আনন্দ পাই , ঠিক সেভাবেই ঈদের দিন বন্ধুরাও আমাকে সেমাই খাওয়ার দাওয়াত দেয়। এটাই বিনিময়টাই তো আসল উৎসব।

ঈদের নতুন জামাকাপড়, বন্ধুদের সঙ্গে কেনাকাটা, রাস্তাঘাটে আলোকসজ্জার ঝলক—সব মিলে ঈদের আমেজ একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এসব অভিজ্ঞতা ধর্মের কোনো ভেদাভেদ মানে না । ঈদের ছুটিতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে যাই, তারাও আসে আমাদের বাড়িতে। এই আন্তরিকতা, এই সৌহার্দ্যই তো প্রকৃত উৎসবের রূপ।

আমি বিশ্বাস করি—ধর্মীয় ভিন্নতা সত্ত্বেও মানুষে মানুষে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সহাবস্থানই সবচেয়ে বড় শক্তি। আমাদের সমাজ হোক এমন এক জায়গা, যেখানে সবাই সকল ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে মিলেমিশে বাস করতে পারে।
সবাইকে ঈদের আন্তরিক শুভেচ্ছা।

[অপুর্ব রায়, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ ]


আত্মত্যাগ করাই সবচেয়ে বড় কোরবানি

বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দেশ,যেখানে ধর্ম,জাতি, ভাষার সমন্বয়ে একটি সর্বজনীন সামাজিক বন্ধন গড়ে উঠেছে।ঈদ মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও এটি কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয় বরং এটি সার্বজনীন উৎসব যা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মাঝে আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। কুরবানি অর্থ ত্যাগ,খোদা বা ঈশ্বর কুরবানি হিসেবে পশু ছাড়াও প্রিয় বস্তুটি গ্রহণ করেন বলে আমি মনে করি। কুরবানির রক্ত বা মাংস আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছায় না,কিন্তু মানুষের মনের পবিত্র ইচ্ছা পৌঁছায়। আমার মনে হয় আত্মত্যাগ করাই সবচেয়ে বড় কুরবানি। যদিও পশু কোরবানি দেয়ার আলাদা তাৎপর্য আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। বাংলাদেশে ঈদ উৎসব মিলনমেলার মতো,যেখানে সব শেনীর মানুষ একত্রিত হয়,ভালোবাসা ও খুশির ভাগাভাগি হয়। বিশেষ করে গরীব মানুষদের জন্য কোরবানি ঈদ অনেক বেশি আশীর্বাদের। 

ছোটবেলায় দেখেছি মুসলমান চাচারা ঈদে দাওয়াত দিতো,আমরাও আনন্দের সাথে দাওয়াতে যেতাম,সালামিও পেতাত,মেলাতে ঘুরতে যেতাম। যখন দেখি গ্রামে ও শহরে ঈদের এই দিনটাতে কে গরীব, কে ধনী, কে খ্রিষ্টান,কে হিন্দু -মুসলিম ভুলে গিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় তখন অনেক বেশি ভালো লাগে।ঈদের এই সময়ে অনেক দিনের ছুটি পাওয়া যায়,বাড়িতে সকলের সাথে সময় কাটানো হয় তাই   ঈদ ইসলাম ধর্মীয় উৎসব হলেও মনে হয় ঈদ আমার ও  বাংলাদেশের সকলের উৎসব। তাই এই ঈদে মুছে যাক সব অহংকার এবং গ্লানিতা। কল্যাণ, শান্তি ও পবিত্রতা আসুক সকলের জীবনে। সবাইকে ঈদ মোবারক।

[সুইটি পালমা, অর্থনীতি বিভাগ]


আনন্দ, উৎসব ও সম্প্রীতির এক অনন্য উপলক্ষ্য

ঈদ মানেই আনন্দ, একসঙ্গে সময় কাটানো, উৎসবের আমেজ। যদিও আমি ধর্মীয়ভাবে ঈদ উদ্‌যাপন করি না, তবুও এই দিনটির বিশেষত্ব অনুভব করা যায় চারপাশের উদ্দীপনা দেখে। বন্ধুদের হাসি, নতুন পোশাক, রাস্তায় সাজসজ্জা—সবকিছুতেই একটা উচ্ছ্বাস থাকে।

ঈদের দিনে অন্যদের খুশি দেখতে পাওয়া নিজেরও আনন্দের কারণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন, অতিথিপরায়ণতা, এবং এক ধরনের সৌহার্দ্য যে পরিবেশ তৈরি করে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। যেকোনো উৎসবই আসলে মানুষের সাথে মানুষের সংযোগের মুহূর্ত তৈরি করে, যা ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও সম্মিলনের বার্তা দেয়। ঈদ সেই ঐক্যেরই উদাহরণ, যেখানে ধর্মীয় পার্থক্যের বাইরে সবাই মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়।
এটা শুধু একটা ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং আনন্দ ও সম্প্রীতির বহিঃপ্রকাশ, যা সকলের জন্যই এক বিশেষ উপলক্ষ্য হয়ে ওঠে।

[জিনেল চাকমা, ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ]


ঈদ কখনোই আমাকে আলাদা করে ভাবতে শেখায়নি 

ধর্ম ভিন্ন হলেও মানবতা আমাদের এক করে রাখে। আমি হিন্দু হলেও ঈদ মানে আমার কাছে আনন্দ, ভালোবাসা, একসাথে থাকার অনুভূতি। ছোটবেলা থেকেই মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের দিন একসাথে খেলা, তাদের বাড়িতে গিয়ে সেমাই খাওয়া, আর নতুন জামা পরা ওদের হাসিমুখ দেখেই যেন আমারও মন ভরে যেত।
ঈদের দিনে মুসলমানদের খুশি আমাকে কখনোই আলাদা করে ভাবতে শেখায়নি, বরং এই উৎসব আমাকে শিখিয়েছে সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব আর সম্প্রীতির মূল্য। আমি মনে করি, ঈদের আনন্দ শুধু মুসলমানদের নয়, আমাদের সবার—কারণ এই দিনে ভালোবাসা ভাগাভাগি হয়, মানুষ মানুষকে আপন করে নেয়।
আজও যখন ঈদ আসে, আমি মুসলিম বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানাই, তাদের বাড়িতে দাওয়াতে যাই, আর মনে মনে কামনা করি—এই বন্ধুত্ব, এই সম্প্রীতি চিরস্থায়ী হোক। ধর্ম হোক যার যার, উৎসব হোক সবার।

[কনিকা পাল, অর্থনীতি বিভাগ]