
আপনি যদি চাটগাঁইয়া হয়ে থাকেন, তবে 'ভইঙ্গা' শব্দটি নিশ্চয়ই খুব পরিচিত। আর আপনি যদি চাটগাঁইয়া না হয়েও চট্টগ্রামে বাস করেন, তবে বলা যায় প্রায় নিশ্চিতভাবেই বহুবার এই শব্দের মুখোমুখি হয়েছেন—হয়তো কারও মুখের কথা, অঙ্গভঙ্গি কিংবা মুখাবয়বের ভঙ্গিমায়।
টিভি সিরিয়াল কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই শব্দ নিয়ে নানা মজাদার শো, পোস্ট ও নাটকের দেখা মেলে। যেমন—চাটগাঁইয়ারা 'ভইঙ্গা ভইঙ্গা' বলে অন্য জেলার মানুষকে ক্ষ্যাপায়, আবার বিপদের সময় সেই ভইঙ্গাদেরই সাহায্যে সবার আগে এগিয়েও আসে। বিপদের বন্ধু, তা-ই না?
চাটগাঁইয়ারা দুষ্টুমিতে সেরা, আপ্যায়নে সেরা, সাহায্য করতে সেরা, খেতেও সেরা, আবার খাওয়াতেও সেরা! পত্রিকার শিরোনামেও কখনো কখনো চোখে পড়ে—'এই নাটকে আমিই একমাত্র ভইঙ্গা'। ফেসবুকেও দেখা যায়, 'হাড্ডি কখনো গোস্ত হয় না, ভইঙ্গা কখনো দোস্ত হয় না'—এ রকম সব হাস্যরসাত্মক উক্তি।
বইন্নগা, বৈঙ্গা, ভইঙ্গা কিংবা ভইঙ্গে—সবই একই শব্দের রূপভেদ। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, 'বইঙ্গা' শব্দের অর্থ 'বাঙালি'। পালি ভাষার 'বঙ্গিয়া' (বঙ্গ + ইয়া) থেকে 'বইঙ্গা' বা 'ভইঙ্গা' শব্দের উৎপত্তি। এটি একটি জাতিবাচক আঞ্চলিক শব্দ, যা অসমীয়া, চাকমা ও চাটগাঁইয়া জনগোষ্ঠীর ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
তবে চট্টগ্রামের মানুষ শব্দটিকে প্রায়শ গালির মতো ব্যবহার করে। মূলত যারা চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন না বা যারা স্থানীয় নন—তাদের উদ্দেশ্য করেই এই নামে ডাকা হয়।
'এ স্টাডি অন দ্য এক্সটিংকশন অব ডায়ালেক্টস ডিউ টু দ্য ইফেক্ট অব ডেমো-লিঙ্গুইস্টিকস: এ কেস স্টাডি ইন বাংলাদেশ' শিরোনামের একটি গবেষণাপত্রে (জানুয়ারি ২০২৩) বলা হয়েছে—চট্টগ্রামে অন্যান্য জেলার ভাষাকে সহজে গ্রহণ করা হয় না। স্থানীয় লোকজন বাইরের উপভাষা গ্রহণে অনিচ্ছুক এবং এই কারণেই যারা এখানে স্থানান্তরিত হন, তারা তাদের আঞ্চলিক উপভাষা ব্যবহার করতে চান না। কেউ যদি নিজের উপভাষায় কথা বলেন, তবে স্থানীয়রা তাকে অপমানসূচকভাবে 'ভইঙ্গা' বলে ডাকেন—যার সঙ্গে মিশে থাকে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ ও তাচ্ছিল্য।
যেমন ধরা যাক শাহেদ জামানের কথা। জামালপুরের ছেলে শাহেদ চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে আছেন দুই বছর ধরে। এই সময়ে বাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে রিকশাচালক, দোকানদার—স্থানীয় বহু মানুষের কাছ থেকেই নিয়মিত 'ভইঙ্গা' শব্দটি শুনতে হয়েছে তাকে। শুধু মুখে নয়, অঙ্গভঙ্গি ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও তিনি এ মনোভাব লক্ষ করেছেন। একটি ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন:
'আমি একবার একটা দোকানে গিয়ে টাকার নোট বদলাতে বললাম, এতটুকুতেই ওরা (চাটগাঁইয়া) বলাবলি করছিল—"এরা ভইঙ্গারা…"। আরেকবার এখানকার অটোরিকশায় উঠব। একজন যাত্রী আমাদের জন্য একটু সরে বসতেও রাজি হলো না। পরে আমরা রাস্তার পাশ ঘুরে অটোতে উঠলাম। কিন্তু বসতেই সেই লোক উঠে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসে পড়ল। যেন আমরা অচ্ছুত!'
শাহেদের মতো তার সহকর্মীরাও প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। মূলত কথাবার্তায় আঞ্চলিক টান না থাকলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, কেউ স্থানীয় নন। তখন ব্যবহারও বদলে যায়।
'এমনভাবে আপনাকে ভইঙ্গা বলে পেছনে কথা বলবে, আপনার মনে হবে এটা আপনারই কোনো দোষ! যেহেতু নন-চাটগাঁইয়াদের এরা বাঁকা চোখে দেখে, তাই কিছু চাটগাঁইয়া শব্দ আমি শিখে নিয়েছি। কথা বলার সময় সেগুলো জুড়ে দিই যাতে বোঝা না যায় আমরা এখানকার নই।'—বলেন তার এক সহকর্মী।
ইতিহাস বলছে, 'বইঙ্গা' শব্দটির উৎপত্তি 'বঙ্গীয়' বা 'বাংলা'—অর্থাৎ বঙ্গ অঞ্চলের মানুষ বোঝাতে। যেমন সিটাঙ থেকে সিটাইঙ্গে (Chittagonian), রোয়াঙ থেকে রোয়াইঙ্গে (Rohingya), তেমনি বঙ্গ থেকে ভইঙ্গা বা ভইঙ্গে (Bengalee)। এ নামগুলোর শেষে 'ইয়া' বা 'ইয়ে' প্রত্যয় যুক্ত হয়।
তবে এখানেই প্রশ্ন উঠে—চট্টগ্রাম কি বাংলা থেকে আলাদা?
এর জন্য যেতে হয় চট্টগ্রামের অতীতে। বন্দরনগরী হওয়ায় চট্টগ্রামের প্রতি বহিঃশক্তির লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে বহুবার। এই অঞ্চলকে নিজেদের অধিকারে নিতে ত্রিপুরা, আরাকান ও মোগল রাজশক্তির মধ্যে হয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
চট্টগ্রামে বাণিজ্য করেছে আরব, ডাচ, পর্তুগিজরা, আর ইংরেজরা তো ছিলই। এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও লেখালেখি থাকলেও ১৫৪০ থেকে ১৫৮৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কোন শাসকগোষ্ঠীর দখলে ছিল—তা নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ ও বিভ্রান্তি। তবে জানা যায়, ১৫৮৬ সালে শেষবারের মতো চট্টগ্রাম আরাকানের নিরঙ্কুশ অধিকারে আসে।
আরাকানিদের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল বর্তমান রাখাইন, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারি পর্যন্ত। আরাকান-শাসিত চট্টগ্রামের বাইরে—নোয়াখালী থেকে শুরু করে অন্যান্য বাংলাভাষী অঞ্চল পরিচিত ছিল বঙ্গ, বঙ্গদেশ, বাঙলা, বাঙ্গালা প্রভৃতি নামে।
আরাকানিরা এই বঙ্গদেশের অধিবাসীদের বাংলাভাষী হিসেবে 'বঙ্গিয়া' বা 'বৈঙ্গা' নামে ডাকত। চাকমাদের মধ্যেও 'বইঙ্গা' শব্দটির প্রচলন রয়েছে, তবে তারা এটি ব্যবহার করে 'যাযাবর' অর্থে।
এ নিয়ে চট্টগ্রাম গবেষক ও লেখক হারুন রশীদ বলেন, 'চট্টগ্রামের লোক তো আলাদা কোনো জাতি না। সবাই তো বাঙালি। সবাই বহিরাগত—নানান দেশ থেকে এসে এখানে মিলিত হয়েছে। কিন্তু যেহেতু আরাকানি প্রভাব ছিল বহুশত বছর, সে কারণে আরাকানের কিছু জিনিস বোধহয় থেকে গেছে সাংস্কৃতিকভাবে।'
মোহাম্মদ তারেকের (ছদ্মনাম) পৈতৃক ভিটে ভোলায় হলেও জন্ম, পড়ালেখা ও চাকরি সবই চট্টগ্রামে। তবু ছোট থেকেই তাকেও 'ভইঙ্গা' পরিচয়ে বড় হতে হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমার সামনে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, শুধু ভইঙ্গা বলে একরকম আপ্যায়ন আর চাটগাঁইয়া হলে আরেকরকম। রেস্টুরেন্টে খাবার খেতেও গিয়েছি, তখনও ব্যাপারটা খেয়াল করেছি। নিজ অঞ্চলের মানুষদের প্রতি সবারই একটা সফট কর্নার থাকে, তবে এখানের বাড়াবাড়িটা বেশি এবং অনর্থক।'
মধ্যযুগে আরাকান ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্য, সাহিত্য ও নৌবাহিনীতে তারা ছিল অদ্বিতীয়। সম্ভবত সেই অহংবোধ থেকেই আরাকানিরা বাঙালিদের হীন চোখে দেখত। কিংবা শুধু 'বাঙালি' বোঝাতেই এই নামে ডাকত।
বাংলাদেশের লোকগবেষক, গীতিকার ও কবি শামসুল আরেফিন বলেন, 'এ নিয়ে সঠিক বা সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। ইতিহাস ঘেঁটে যতটুকু বুঝি, বৈঙ্গা এসেছে বাঙালি শব্দ থেকে। চট্টগ্রাম তো বাংলার বাইরে ছিল। তাই বৈঙ্গা ডাকা হতো। আবার চট্টগ্রামের যারা বৈঙ্গাদের সঙ্গে মিশে যেত, তাদের বলা হতো বাঙাল। এটার সঙ্গে কোনো অপমানসূচক অর্থ জড়িত ছিল না।'
তবে সময়ের সঙ্গে শব্দটির মধ্যে হয়তো কিছুটা ব্যঙ্গ কিংবা বিদ্রূপ যুক্ত হয়েছে।
যেমন চট্টগ্রামের মেয়ে লাবণ্য আহমেদ বলেন, 'এই একটা শব্দ দিয়ে তারা অনেক কিছু বোঝায়। যেমন, ভইঙ্গা মানে ছোট জাত, কৃপণ, গরিব, বহিরাগত ইত্যাদি। চাটগাঁইয়াদের ধারণা, তাদের মতো জমিদারি চালচলন অন্য জেলার মানুষের মধ্যে নেই।'
তিনি বলেন, 'হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলেই তো সবাই ব্যবসা করতে এসেছে, শাসন করতে এসেছে। দেশের বড় বড় শিল্পপতিরাও তো এখান থেকেই উঠে এসেছে। সেকারণেই এদের মধ্যে একটা জাত্যাভিমান ঢুকে গেছে। তারা ভাবে, এখানকার মানুষের মন বড়, নজর বড়—যেকোনো দরকারে তারা দুই হাতে খরচ করতে পারে। ভইঙ্গাদের মতো কৃপণ, ছোট মন-মানসিকতা তাদের নেই।'
'এমনকি চাটগাঁইয়ারা "ভইঙ্গা" বলার মাঝেও খুঁজে পায় একধরনের পৈশাচিক তৃপ্তি!'—অভিযোগ করেন লাবণ্য।
গবেষক হারুন রশীদ বলেন, 'বঙ্গ কিংবা বাঙাল ইত্যাদি শব্দ বহু বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ কিংবা এ অঞ্চল থেকে অপমানসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কেন হচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে জানা নেই। কিন্তু কাউকে নীচু জাত বোঝাতেই সাধারণত এই শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়। সাংস্কৃতিকভাবেই এই গাঙ্গেয় অঞ্চলের মানুষ অন্য জাতি বা গোত্রকে হেয় করে আনন্দ পায়—এটা অহেতুক গর্ব করার একটা উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
তবে অন্য সব অঞ্চলের মতো, সব চাটগাঁইয়াই যে এমন—তা নয়।
এমনই একজন বৈশালী গুহ (ছদ্মনাম)। জন্মসূত্রে চাটগাঁইয়া, আদিবাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী। সদ্য এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উমেন থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।
বৈশালী নিজেও মজা করে 'ভইঙ্গা' বলে ডাকেন বন্ধুদের। তিনি জানান, 'ইউনিভার্সিটিতে আমার সব বন্ধুই চট্টগ্রামের বাইরের। আমি মজা করেই মাঝে মাঝে ভইঙ্গা বলি। কিন্তু কখনোই অপমান বা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের জন্য বলি না। উলটো চেষ্টা করি যেন চট্টগ্রামের বাইরের কেউ নিজেকে বহিরাগত মনে না করে। আমি জানি, অনেকেই এটা গালি হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু আমার কাছে চাটগাঁইয়া-ভইঙ্গা—সবই এক।'