
বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিটি ওঠানামা যেন সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে স্বর্ণের দামে। একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী স্বর্ণ ক্রয়, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও মুদ্রাস্ফীতির ভয় সব মিলিয়ে স্বর্ণ আজ কেবল অলংকারের উপাদান নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার এক নিঃশব্দ নির্দেশক।
২০২৫ সালের শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে, একদিকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান, অন্যদিকে ফেডারেল রিজার্ভের সুদহারের নীতি, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত-এসব সবকিছু একত্রে স্বর্ণের বাজারকে এমন এক অনিশ্চিত ও সংবেদনশীল জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে দাম বাড়ছে একদিকে, কিন্তু অস্থিরতা কমছে না আরেকদিকে।
বিশ্বব্যাপী যখন মুদ্রার ওপর আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়, তখন মানুষ ফিরে যায় সেই প্রাচীন অথচ পরীক্ষিত নিরাপদ আশ্রয়ে-স্বর্ণে। আর ঠিক সেই সময়েই স্বর্ণের বাজার হয়ে ওঠে একটি অর্থনৈতিক ব্যারোমিটার, যা শুধু দামের পরিবর্তন নয়, বরং বিশ্বের আর্থিক এবং কূটনৈতিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে এক শক্তিশালী বার্তা দেয়।
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় বাড়ছে নিরাপদ আশ্রয়ের চাহিদা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনার মতো ঘটনায় বিনিয়োগকারীরা বারবার নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছেন স্বর্ণে। শুধু ২০২৫ সালের প্রথমার্ধেই, এসব সংঘাতজনিত আশঙ্কায় স্বর্ণের দাম একাধিকবার রেকর্ড ছুঁয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব যখন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়, তখন মানুষ স্বর্ণেই আশ্রয় নেয়।’
ডলারের দাম কমলে স্বর্ণের দাম বাড়ে
ডলারের মান আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে স্বর্ণের দাম সাধারণত বাড়ে। কারণ, তখন অন্যান্য দেশের ক্রেতাদের জন্য স্বর্ণ কেনা তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে পড়ে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ যখন সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দেয়, তখনও স্বর্ণের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। কারণ সুদের হার কমা মানে-মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা এবং তার বিরুদ্ধে স্বর্ণকে হেজিং হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে স্বর্ণ কেনা
২০২৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ ক্রয় রেকর্ড ছুঁয়েছে। চীন, পোল্যান্ড, ইরানসহ অনেক দেশই ডলারনির্ভরতা কমাতে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকেছে। মেটালস ফোকাস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে এই ক্রয় ১,০০০ মেট্রিক টন ছাড়াতে পারে।
সরবরাহ সীমিত, চাহিদা বাড়ছে
বিশ্বের স্বর্ণ খনি থেকে উৎপাদন বছরে গড়ে ২-৩ শতাংশ হারে বাড়ে। তবে সেই তুলনায় বিনিয়োগ, গহনা ও প্রযুক্তি খাতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতে বিয়ের মৌসুম, চীনে নববর্ষ বা উৎসবের সময় স্বর্ণের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে যায়।
বাজার বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী
কিছু আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা যেমন-মর্নিংস্টার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, আগামী পাঁচ বছরে যদি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হ্রাস পায় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বর্ণ কিনে না চলে, তবে দাম ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। আবার অপরপক্ষের মত, বিশ্বে যদি যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হয়, তবে স্বর্ণের দাম আরও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম শুধু ধাতুর গায়ে খোদাই নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির উত্তাপ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, এবং মানুষের মনের ভয় ও প্রত্যাশার প্রতিফলন। বিনিয়োগের আগে তাই শুধু দাম নয়, দৃষ্টিতে রাখতে হবে গোটা বিশ্ব অর্থনীতির পালাবদলকেও।
তথ্য সূত্র: রয়টার্স, ইনভেস্টোপিডিয়া ডট কম, ডিসকভারিঅ্যালার্ট, সুইসবুলিয়ন ডট ইউ, আইনিউজ ডট জুমবাংলা ডট কম, গোল্ড মার্কেট ডট ফিআর, দ্য জুয়েলহাব ডট কম, বুলিওজায়ান্ট ডট কম, সুইসগোল্ড ডট কম, এসবিসিগোল্ড ডট কম, ওয়াল্ড গোল্ড প্রাইস ডট কম।