Image description

গত ৫ আগস্টের পর গোপন নির্যাতন সেলের আলামত নষ্ট করেছে র‍্যাব। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, 'আমাদের কাজ যত এগোচ্ছিল, ততই আলামত নষ্টের বিষয়গুলো আমাদের সামনে প্রকাশ পেতে থাকে।'

প্রতিবেদনে দুইটি স্থাপনায় র‍্যাবের আলামত নষ্ট করার বিস্তারিত প্রমাণ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদন মতে, প্রথম স্থাপনাটি হলো র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশনের (টিএফআই) গোপন সেল। র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখা এটিকে 'হাসপাতাল' নামে অভিহিত করত। দ্বিতীয় স্থাপনাটিও র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখা পরিচালনা করত, যা 'ক্লিনিক' নামে পরিচিত। 

৫ আগস্ট মুক্তি পাওয়ার আগে টিএফআইর গোপন সেলে আট বছর আটক ছিলেন ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান। ওই ঘটনার তদন্ত করতে যেয়ে কমিশন অনুধাবন করে, 'হাসপাতালে' আলামত নষ্ট করা হয়েছে।

টিএফআই সেন্টার হলো র‍্যাব-১ এর কম্পাউন্ডে অবস্থিত একটি স্থাপনা। তবে এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল র‍্যাবের সদর দপ্তর।

প্রতিবেদনে বলা হয়, '২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর আমরা প্রথমবারের মতো টিএফআই'র গোপন সেল সরেজমিনে পরিদর্শন করি। সে সময়, কর্মকর্তারা আমাদেরকে জানান, ওই স্থাপনাটি অন্তত দুই বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে ওই তথ্য আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়েছে। স্থাপনাটি একেবারে ভগ্নদশায় ছিল এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, পুরো জায়গাটি অনেকদিন ধরে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে ছিল।'

তবে শিগগির তারা বুঝতে পারেন, র‍্যাব তাদেরকে মিথ্যা বলেছে।

'টিএফআইর স্থাপনাটি তিনটি সুনির্দিষ্ট অংশে বিভক্ত ছিল: প্রশাসনিক অঞ্চল, বন্দিদের আটকে রাখার বড় জায়গা এবং জেরা ও নির্যাতনের জন্য একটি ছোট জায়গা'। নির্যাতন কক্ষের জন্য নির্ধারিত অংশের ভেতর আরও কিছু লুকানো কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। এগুলোতে লম্বা সময় ধরে আটক থাকা বন্দিদের রাখা হতো

এরকম একটি কক্ষেই আটক ছিলেন ব্যারিস্টার আরমান।

ব্যারিস্টার আরমান কমিশনকে জানান, তাকে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানে তিনি টাইলসের অস্তিত্ব টের পেয়েছিলেন। তবে কমিশনের সদস্যরা টিএফআই পরিদর্শনের সময় এই বর্ণনার সঙ্গে মেলে, এমন কোনো কক্ষ খুঁজে পাননি।

তারা ব্যারিস্টার আরমানকে তার হাঁটাচলার পথের একটি মানচিত্র আঁকতে বলেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, 'যদিও বন্দিত্বের বেশিরভাগ সময় তার চোখ বাধা ছিল, তবুও তার আশেপাশের জায়গাগুলো সম্পর্কে তিনি খানিকটা ধারণা পেয়েছিলেন। কখন, কোথায় ঘুরেছেন, সিঁড়ি দিয়ে নেমেছেন বা সোজা হেঁটেছেন—এ ধরনের বিষয়গুলো।'

প্রতিবেদনে বর্ণিত, 'মানচিত্রে তিনি একটি ছোট সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে সোজা এগিয়ে যাওয়া এবং এরপর বাঁয়ে মোড় নিয়ে একটি সেলে প্রবেশ করার কথা বর্ণনা করেন। তবে আমরা নিজেরা যখন একই পথ ধরে আগানোর চেষ্টা করি, তা (আরমানের) বর্ণনার সঙ্গে মেলেনি। তার বর্ণিত সেলে পৌঁছাতে হলে ডানে ঘুরে তারপর বাঁয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এই তথ্যের গড়মিল আমাদের মনে আরও সন্দেহ জাগায়।'

এরপর ব্যারিস্টার আরমান টিএফআইর ভেতরে তোলা ছবিতে অসামঞ্জস্য খুঁজে পান। দেওয়ালের একটি অংশ থেকে যেভাবে আলোর প্রতিফলন হচ্ছিল, তা বাকি অংশ থেকে ভিন্ন। 'তিনি মন্তব্য করেন, সম্ভবত এখানেই তার সেলের প্রবেশপথটি ছিল, যা পরবর্তীতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে', প্রতিবেদনে বলা হয়।

এরপর কমিশন ভেতর ও বাইরের দেওয়ালের দৈর্ঘ্য মাপার কাজ শুরু করে। কমিশনের সদস্যদের ধারণা করেন, যেহেতু সেখানে তথ্যের গড়মিল আছে, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সেখানে গোপন চেম্বার রয়েছে।

তারা ১০ ফুটেরও বেশি ফাঁকা জায়গা খুঁজে পান।

'এরপর দেওয়াল ভেঙে ফেলা হয়। পেছনে আমরা একটি লুকানো সেল খুঁজে পাই, যা প্রায় অবিকৃত ছিল। এই সেলটি আরমানের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এই ঘটনা এবং আরও বেশ কয়েক ধরনের তথ্য প্রমাণ নিশ্চিত করে যে তিনি আট বছর গুম থাকার বেশিরভাগ অংশ সেখানেই কাটিয়েছেন। পাশাপাশি, এটাও প্রমাণিত হয় যে আরমান ৫ আগস্ট মুক্তি পাওয়ার পর ঘরটি সিল করে দেওয়া হয়েছিল।'

২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর কমিশন প্রথমবারের মতো ওই স্থাপনা পরিদর্শন করে।

প্রতিবেদন মতে, 'সম্ভবত আগস্টের পর থেকে অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ে আমাদের পরিদর্শনের মাঝের সময়টিতে ওই কক্ষটি লুকিয়ে ফেলা হয়। হাসিনা সরকারের পতন সত্ত্বেও এ ধরনের উদ্যোগে এটাই প্রমাণ হয় যে এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে আলামত নষ্ট করে জবাবদিহি এড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।

কমিশন বলছে, এ ধরনের আলামত নষ্টের ঘটনার আগেই র‍্যাবের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রদবদল করা হয়েছিল। 'সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি, অপারেশনস) পরিবর্তন করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, নতুন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের অধীনেই আলামত ধ্বংসের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।'

'এই ঘটনার মাধ্যমে র‍্যাবের গভীরে প্রোথিত একটি সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে: আগে কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও নতুন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের মতো কর্মকর্তারা অজ্ঞাতে এমন এক দায়মুক্তির সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, যেখানে জবাবদিহির চেয়ে অপরাধ গোপন রাখাকে বেশি উৎসাহ দেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে, একের পর এক কর্মকর্তা তাদের পূর্বসূরিদের হাত দিয়ে সংঘটিত অপকর্ম ও অপরাধ ধামাচাপা দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আমরা বিশ্বাস করি, এই প্রবণতার কারণেই র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে আমাদেরকে এতটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

র‍্যাব অপর যে কেন্দ্রে আলামত নষ্ট করেছে, তার নাম দেওয়া হয় 'ক্লিনিক।'

'র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখা ৫ আগস্ট পর্যন্ত অপর একটি গোপন বন্দিশালা পরিচালনা করত। র‍্যাবের সদরদপ্তরের ভেতরেই ছিল এর অবস্থান। একে 'ক্লিনিক' নামে ডাকা হতো। এর বাইরের অংশে কাঁচের প্যানেল ছিল। তাই বলা হতো, 'কাঁচের ঘরের' ভেতর ক্লিনিকের অবস্থান। জানা গেছে, এক পর্যায়ে এই স্থাপনার চতুর্থ তলায় প্রায় ছয়টি ছোট ছোট সেল ছিল।'

এই স্থাপনাটি ২০২৫ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো চিহ্নিত করা হয়। 'সরেজমিনে দেখা যায়, ইতোমধ্যে এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে আসা ব্যক্তিরা তাদের জবানবন্দির অংশ হিসেবে যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে ভেতরের কাঠামো পুরোপুরি মেলে না। তবে ছাদের বিম, পার্টিশন থাকার প্রমাণ এবং দেয়াল থাকার চিহ্ন থেকে বোঝা যায়, ওই জায়গাটিতে আগে ছয়টি পৃথক সেল ছিল'।

কমিশনের পরিদর্শনের সময় মাত্র চারটি কক্ষ টিকে ছিল।

'দুইটি দেওয়াল সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, এবং রূপান্তরিত জায়গাটিতে নতুন করে টাইল বসিয়ে এগুলোকে বাথরুমের অভ্যন্তরের মতো রূপ দেওয়া হয়। সার্বিকভাবে বলা যায়, পুরো জায়গাটিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।'

কমিশনের মতে, এ ধরনের রূপান্তর এটাই ইঙ্গিত করছে যে সময় নিয়ে, পরিকল্পনার মাধ্যমে এ কাজগুলো করা হয়েছে।

'আগের মজুত থেকে কিছু উপকরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকলেও, এই কাজের জন্য সমন্বয় ও নতুন নির্মাণ সামগ্রীর সরবরাহ প্রয়োজন। সিমেন্ট, টাইলস, সরঞ্জাম ও কাজ করার জন্য মানুষকে সেখানে নিয়ে যেতে হয়েছে। কাজের বাস্তবায়ন ও এর পেছনে দেওয়া সময় এটাই ইঙ্গিত করছে যে এই প্রক্রিয়ার পেছনে লজিস্টিক পরিকল্পনা ও বাজেট সহায়তা পাওয়া গেছে। এ পুরো বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনো স্পষ্ট নয়, তবে এটা নিশ্চিত যে জায়গাটিকে নতুন করে সাজানোর বিষয়টি কোনো দিক দিয়েই এলোমেলোভাবে করা হয়নি।'

সেল ধ্বংসের পাশাপাশি, র‍্যাব নির্যাতনে ব্যবহৃত কিছু উপকরণও সরিয়ে ফেলেছে।

'এগুলোর মধ্যে ছিল রিভলভিং চেয়ার, যেগুলোর মাধ্যমে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো এবং তাপ ব্যবহার করে নির্যাতন করার যন্ত্র।'

কমিশনের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, 'বেঁচে ফিরে আসা মানুষরা তাদের জবানবন্দিতে আরও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের কথা বলেছেন। যার মধ্যে আছে চাবুক, ছুরির মতো ধারাল অস্ত্র ও দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা নির্যাতন-উপকরণ। পাশাপাশি, ঘরকে সাউন্ড প্রুফ রাখার সরঞ্জামও ছিল। এগুলো সবই ধ্বংস করা হয়েছে।'

কমিশন এ কাজগুলোকে '৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়টিতে ভৌত প্রমাণ ধ্বংসের বৃহত্তর উদ্যোগের অংশ' হিসেবে অভিহিত করেছে।