Image description

সাড়ে তিন দশক আগেও আদা উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। উৎপাদন যা হতো, তা দিয়ে মিটত দেশের চাহিদা। আদা বেচাকেনায় যুক্ত ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তাঁদের ‘জাহাজের খবর’ নেওয়ার মানেই ছিল বড় বিষয়ে নাক গলানো।

তবে সেই দিন বদলে গেছে। কয়েক দশক ধরে সেই ‘আদার ব্যাপারীদের’ এখন জাহাজের খবর নিতে হয়। কারণ, আদা আমদানিনির্ভর হয়ে গেছে। আমদানিনির্ভর এই আদা আসছে বড় বড় জাহাজে। শুধুই জাহাজে বললে ভুল হবে, উড়োজাহাজেও আসছে আদা।

হাজার বছর ধরে এই খাদ্যপণ্যটি রান্নায় ব্যবহার হয়ে আসছে। ‘বাঙালির খাদ্যকোষ’ বইতে লেখক মিলন দত্ত জানাচ্ছেন, ‘রান্নায় আদার রস দেওয়া বা আচারে আদার ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় চালু ছিল। আদা খাদ্যে, পানীয় তৈরিতে, আচার, ওষুধ এবং সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহার হয়।’ 

রান্না ছাড়াও ভেষজ গুণের কারণে কাঁচা আদার ব্যবহার বাড়ছে। আদা দিয়ে রং–চা বেশ জনপ্রিয়। পেটফাঁপা, পেটব্যথা, জ্বর জ্বর, বমি বমি ভাব হলে এক টুকরো আদা চিবিয়ে খান অনেকেই। আদার এই বহুমুখী ব্যবহারে চাহিদা বাড়ছে রকেট গতিতে। তাতে উৎপাদন দিয়ে এই চাহিদা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে আদা আমদানি বেড়েছে প্রায় ১৮ গুণ। এখন চাহিদার প্রায় ৬৫ শতাংশই আমদানি করতে হচ্ছে।

আদার এই আমদানিনির্ভরতা বাংলাদেশকে শীর্ষস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। যেমন গত বছর পরিমাণের হিসেবে সবচেয়ে বেশি আদা আমদানি করেছে বাংলাদেশ। পেছনে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোকে। এমন তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র।

প্রাচীনকালে রসুইঘরে জায়গা করে নেওয়া আদা হঠাৎ করেই এত জনপ্রিয় হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশে আদা উৎপাদন ও আমদানির হিসাবে চাহিদার একটা চিত্র পাওয়া যায়। সংস্থাটির তথ্যভান্ডার বলছে, স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে বছরে গড়ে ৩৬ হাজার টন করে আদা উৎপাদন হতো। পরের দশকে তা ৩৯ হাজার টনে উন্নীত হয়।

উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বাড়তে থাকায় নব্বই দশকে আদার আমদানি শুরু হয়। শুরুতে চাহিদার ৭–৮ শতাংশ আমদানি হতো। এই শতকের প্রথম দশকে চাহিদার ২০ শতাংশ করে আমদানি হয়। পরের দশকে তা দ্বিগুণ হয়। এখন তো ৬৫ শতাংশই আমদানি করতে হচ্ছে, পরিমাণের হিসেবে বছরে দেড় লাখ টন।

পুরোনো প্রবাদ–প্রবচনের দোহাই দিয়ে আদার ব্যবসায়ীদের এখন তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করার দিন শেষ। কারণ, আদা এখন হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। গত বছরের উদাহরণ দেওয়া যাক। এ সময়ে ১ লাখ ৫২ হাজার টন আদা আমদানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য ছিল ৩ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। দেশীয় উৎপাদনের বাজারমূল্য যোগ করা হলে তা চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

আদা নিয়ে প্রবাদ মূলত আদার ব্যবসায়ীকে ঘিরে। তাঁদেরও দেখে আসা যাক। গত বছর ৪৯৮ জন ব্যবসায়ী আদা আমদানি করেছেন। তাঁদের কারও কারও লেনদেন শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠবে! একজনের কথাই বলি, ঢাকার সূত্রপুরের তাজ গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের বার্ষিক লেনদেন শত কোটির বেশি। প্রতি তিন দিনের কম সময়ে একটি করে চালান জাহাজে এনেছে এই প্রতিষ্ঠান। জাহাজের খোঁজ তো তাকে রাখতেই হবে। আদার ব্যবসায়ীরা যে সব কোটিপতি তা কিন্তু নয়। যেমন চট্টগ্রামের আরপিএস ইন্টারন্যাশনাল কিং ঢাকার অর্কিড ট্রেডিং বছরে মাত্র এক কনটেইনার করে আদা এনেছে। বছরে কোটি টাকাও পার হয়নি তাদের আদার লেনদেন। তবু ঠিকই জাহাজের খবর রাখতে হয়েছে।

 

দেশের কথা তো হলো, এবার একটু আদার বাণিজ্যে বিশ্বভ্রমণ করে আসা যাক। বিশ্বব্যাপী মসলা বাণিজ্যে আদার অবস্থান খুব একটা খারাপ নয়। গত বছর বিশ্বে ১৪৮ কোটি ডলারের আদা রপ্তানি করেছে শতাধিক দেশ। এই আদা আমদানি করেছে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশসহ ১৮৯টি দেশ।

আমদানিতে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ অবশ্য বিশ্বের ১১ দেশ থেকেই এই পণ্যটি আমদানি করে। ভারত ও চীন—এই দুই দেশ থেকে আমদানি হয় ৭০ শতাংশ। মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড থেকেও আদা আসছে। জাহাজে করে সাধারণ কনটেইনারে আদা আমদানির সুযোগ নেই। পচনশীল আদা যাতে ভালো থাকে, সে জন্য আনা হয় শীতাতপনিয়ন্ত্রত কনটেইনারে। হয়তো সুদূর চীন থেকে কনটেইনার তুলে দেওয়া হয় জাহাজে। খাতুনগঞ্জ বা মৌলভীবাজারে বসে কনটেইনার পরিবহনের পথ ট্রাকিং করে দেখতে পান আদার ব্যবসায়ীরা। সরবরাহ একটু কম হলেই নড়েচড়ে বসেন তাঁরা। কারণ, দাম বেড়ে যায়। কত দ্রুত কনটেইনার নামবে জাহাজ থেকে? সেই চিন্তায় নিয়মিত খোঁজ রাখতে হয় তাঁদের।

আদার ব্যাপারী মানে ব্যবসায়ীদের এ অবস্থানে নিয়েছে মূলত ভোক্তারা। কারণ, ভোক্তারা এই পণ্যটি আগের তুলনায় বেশি কিনছেন। এক দশকের ব্যবধানটা দেখা যাক। এক দশক আগে পরিবারপ্রতি বছরে আদার ভোগ ছিল সাড়ে তিন কেজির কিছু বেশি। এখন পরিবারপ্রতি আদার ব্যবহার বেড়ে হয়েছে পৌনে ছয় কেজি। রসুইঘর ঘুরে আসুন, আপনার ঘরেও আদা থাকার সম্ভাবনা প্রবল। গোটা না থাকলেও ফ্রিজে থাকতে পারে আদার পেস্ট।