
দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প দীর্ঘ দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত অবহেলা এবং একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের কব্জায় বন্দি হয়ে ধ্বংসপ্রায়। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকারের আমলে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই শিল্পকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, যার অন্যতম প্রমাণ প্রতি কোরবানির ঈদে বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া ভারতে পাচার হওয়ার ঘটনা।
এবছর প্রথমবারের মতো সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। ফলে কোরবানির সময় চামড়া পাচার রোধের আশা করছেন ট্যানারি মালিকরা। গত কয়েক বছরে লক্ষ্য করা গেছে, কোরবানির ঈদের সময় দেশজুড়ে সংগৃহীত বিপুল কাঁচা চামড়ার একটি বড় অংশ পাচার হয়ে যেত সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার চামড়া পাচার করলেও, সরকার তা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।
তবে এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। শিল্প মালিকদের বক্তব্য অনুযায়ী, পাচারের পথগুলো নজরদারিতে আনা হয়েছে, এবং মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় রাখা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এবার চামড়া পাচারের মতো ঘটনা ঘটবে না।পাচার রোধের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে উঠে আসছে ‘কমপ্লায়েন্স’ ইস্যু। সাভারের হেমায়েতপুরে ২০১৭ সালে স্থানান্তরিত হওয়া চামড়া শিল্প নগরীতে এখনো পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সনদ পায়নি একটিও কোম্পানি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাভারে মোট ১৪২টি কোম্পানি রয়েছে, এর একটিও এখনো কমপ্লায়েন্স অর্জন করতে পারেনি।’ এর ফলেই ইউরোপ ও আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছে।সাভারের ট্যানারি মালিক রেজাউল হক আমার দেশকে জানান, বিগত সরকারের পুরো সময়ে ট্যানারি শিল্প নগরীর কোনো উন্নয়ন হয়নি বরং তারা ভারতের স্বার্থে পাচারের সব পথ খুলে দিয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘যখন সাভারের হেমায়েতপুরে প্রথমে ট্যানারি স্থাপন হয়, তখন থেকেই নীতিগত গলদের কারণে কাঙ্ক্ষিত পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি।’
রপ্তানি কমছে
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চামড়া রফতানি ৮.২৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০৭.৬১ মিলিয়ন ডলারে। গত অর্থবছর এ অংক ছিল ১১৭.২৭ মিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে দেশীয় বাজারে চাহিদার অভাবে কোরবানির সময় সংগৃহীত চামড়ার বিশাল অংশ অবিক্রীত থাকছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘চাহিদা না থাকলে মূল্য বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বিক্রি না হলে উৎপাদক কেন কিনবে?’ ফলে সরকার মূল্য নির্ধারণ করলেও বাস্তবে বাজারে তা প্রতিফলিত হয় না।
মূল্য নির্ধারণেও অস্বচ্ছতা
চলতি বছর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম ৬০–৬৫ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৫৫–৬০ টাকা নির্ধারণ করেছে। যদিও এটা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি, তারপরও বাজারে ক্রেতার অনুপস্থিতি এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ সংকটের কারণে চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না সংগ্রাহকরা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের পর আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামোর। কিন্তু আট বছর পেরিয়ে গেলেও এর কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ হিসেবে স্বীকৃতি মিলছে না।