
জুন শুরু হলেই বন্যা ও টিলা ধসের আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় সিলেটবাসীকে। এ সময় ভারী বর্ষণে মাটি নরম হয়ে যায়। তখন টিলা ধসে মাটিচাপায় ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। পাহাড়ি ঢলে শত শত গ্রাম প্লাবিত হয়, ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘর বাড়ি।
সিলেটের প্রতিটি পাহাড়-টিলা এখন ভূমিদস্যুদের লোভাতুর দৃষ্টি রয়েছে। টিলা কাটা নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা হলেও থেমে নেই এই ধ্বংসযজ্ঞ। টিলা কেটে ক্ষত-বিক্ষত করে রাখে ভূমিদস্যুরা। ফলে সিলেটে প্রতিবছর টিলা ধসের ঘটনা অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দুর্ঘটনার আশঙ্কা জেনেও টিলা কেটে ঝুকিপূর্ণ স্থান টিলার ওপর ও পাদদেশে ঘরবাড়ি নির্মাণের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার পাহাড় টিলাবেষ্টিত এলাকায় অবাধে বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস বিপজ্জনক ও ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
অবাক বিষয় হচ্ছে- এসব দুর্ঘটনার খবর কিছুদিন পর প্রশাসনের কাছে যেভাবে চাপা পড়ে। ঠিক তেমনি চাপা পড়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছেও। অথচ প্রতিবছর টিলা ধসে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। অথচ এসবের যেন কোনো প্রতিকার নেই।
জানা যায়, টিলার পাদদেশে এসব বসবাসকারীদের বেশির ভাগই ভাড়াটিয়া। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলার মাটি কাটা ও দখলের জন্য হত দরিদ্র এসব মানুষকে ঘর বানিয়ে থাকার সুযোগ করে দেন। এ ছাড়া, কম দামে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে। তবে পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাস করা পরিবারগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই সিলেট জেলা প্রশাসনের কাছে।
সিলেটে টিলা ধস ট্রাজেডি অথবা টিলা ধসে যত মৃত্যু
সম্প্রতি সিলেটের গোলাপগঞ্জে পাহাড় ধসে একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু সারাদেশে চাঞ্চল্যে সৃষ্টি করে। রোববার (১ জুন) সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ এলাকায় টিলাধসে ঘুমন্ত একটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তানের প্রাণহানি ঘটনা ঘটলে সমগ্র সিলেটে শোকাভিভূত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মাটিচাপা পড়া চারজনের মরদেহ দীর্ঘ ৫ ঘণ্টার সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয়। টনক নড়ে ওঠে জেলা প্রশাসনের। কর্তাব্যক্তিরা নিহতদের বাড়িতে যান এবং ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেন।
২০২৪ সালের ১০ জুন সিলেট নগরের মেজরটিলা চামেলিবাগ এলাকায় টিলা ধসে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের এক সন্তানের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটে। ২০২২ সালের ৬ জুন সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের পূর্ব সাতজনি গ্রামে টিলা ধসে একই পরিবারের চার জনের প্রাণহানি ঘটে। এভাবে প্রতিবছর টিলা ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

টিলার পাদদেশে এভাবেই বাড়িঘর তৈরি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে মানুষ। ছবি: সারাবাংলা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট শহরতলী এলাকার আখালিয়া, তারাপুর চা-বাগান, হাওলাদার পাড়া, পীরমহল্লার ব্রাহ্মণশাসন, দুসকি, টিলারগাঁও, মেজরটিলা, ইসলাপুর, জোনাকি, মংলিরপাড়া, খাদিমনগর, জাহানপুর, খাদিমপাড়া, বালুচর, পাঠানটুলা গুয়াবাড়ি, জাহাঙ্গীরনগর, আখালিয়া বড়গুল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা টিলাসহ পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে ঘর বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। বাসিন্দারা কেউ ঘর ভাড়া নিয়েছেন, কেউ নামমাত্র টাকা দিয়ে দখলদারদের কাছ থেকে জায়গা কিনেছেন।
এছাড়াও সিলেট জেলার উপজেলাগুলোর মধ্যে গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুরসহ সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় টিলায় গত দেড় দশকে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি। দিন দিন এসব এলাকায় পাহাড় টিলা কেটে অথবা টিলার পাদদেশে এক ভয়ংকর বসতি গড়ে উঠেছে। টিলা ও পাহাড় কেটে টিনের আধা পাকা কিংবা পাকা দালান তোলা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে যখন একাধারে বৃষ্টি হয় তখন ঘরবাড়ি ধসে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
যা বলছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এ সংস্থার সিলেটের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আখতার ২ জুন বলেন, গত ১২ বছরে পাহাড় টিলা ধসে ৬২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সিলেটে প্রায় প্রতিবছর বর্ষাকালে টিলা ও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।
তিনি আরও জানান, ১৩ বছর আগের উচ্চ আদালতের রায় দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অথচ থামেনি টিলা কাটা। থামেনি টিলার পাদদেশের বাসিন্দারা মাটিচাপা পড়ে প্রাণহানির ঘটনা।
‘টিলা কাটা রোধে উচ্চ আদালতের রায়, আদেশ সম্বলিত সাইনবোর্ড লাগানো প্রসঙ্গ’ শিরোনামে জেলা প্রশাসককে দেওয়া বেলার ওই চিঠিতে সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর এবং গোপালগঞ্জ উপজেলায় বিদ্যমান পাহাড়, টিলা কর্তন রোধে ২০১১ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলার প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১ মার্চ আদালতের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, পাহাড়, টিলা কর্তন থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করে আদালত।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টে’র প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই সারাবাংলাকে, ‘আমরা শেষ ২০১৭ সালে জরিপ করি তখন সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা ও শহরতলীতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ঝুকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। এরপর অনেকে টিলা কেটে ঘরবাড়ি বানিয়েছে। এই সংখ্যা এখন কয়েক হাজার বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘জরিপের সময় আমরা দেখেছি প্রভাবশালী মহল টিলার একাংশ কেটে সঙ্গে সঙ্গে টিনের আধা পাকা কিংবা পাকা দালান তৈরি করেন। বর্ষা মৌসুমে যখন মুষলধারে বৃষ্টি হয় তখন টিলা ধসে ঘরবাড়িতে আছড়ে পড়ে। এতে মাটিচাপা পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিলেটে নির্বিচারে পাহাড় টিলা কাটা হয়। পাহাড় কাটার কৌশল হিসেবে পাহাড়ের পাদেশে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বসতি বানানো হয়। ঝুঁকি নিয়ে কয়েক হাজার মানুষ বাস করেন এসব পাহাড়-টিলার আশপাশে। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাহাড় বা টিলাধসে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।’ৎ

টিলার পাদদেশে এভাবেই বাড়িঘর তৈরি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে মানুষ। ছবি: সারাবাংলা
যা বলছেন জেলা প্রশাসক
সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহমুদ মুরাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝিতে পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাসকারী মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নিদের্শ দেওয়া হয়েছে। এলাকাগুলোতে মাইকিং করে তাদের বলা হলে অনেকে সরে যান। কিন্তু কেউ কেউ প্রশাসনের এই নির্দেশকে উপেক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস করছিলেন। গোলাপগঞ্জে চারজনের প্রাণহাণির ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মাইকিংয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন পাহাড় টিলায় বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত দেড় দশকে সিলেটের ৬১টি টিলা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। জেলার ৪১২টি পাহাড়-টিলার মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ৩৫১টি। সরকারি হিসাবে ধ্বংস হওয়া টিলার সংখ্যা ৬১টি বলা হলেও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে-এমন বেসরকারি সংস্থাগুলোর দাবি, গত দেড় দশকে শতাধিক টিলা নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্যনুযায়ী, সিলেট বিভাগে ১ হাজার ৭৪৫টি টিলা রয়েছে। টিলাভূমির পরিমাণ ২ হাজার ৭৪৯ দশমিক ৫০ একর। এর মধ্যে সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বেশির ভাগ টিলা। সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলায় ১০৫টি টিলা রয়েছে। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে ৬১৫টি টিলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৯১টি টিলা খাস খতিয়ানভুক্ত।
সিলেট সিটি করপোরেশন, সদর উপজেলা, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে ১ হাজার ২৫টি টিলা রয়েছে এবং ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এবং সদর ইউনিয়নে ২৫১ একর টিলাভূমি রয়েছে। এসএ রেকর্ড অনুযায়ী, সিলেট জেলায় ২০০৯ সালে টিলার সংখ্যা ছিল ১০২৫টি আর বর্তমানে এর সংখ্যা মাত্র ৫৬৫টি।