Image description
বাজেট ২০২৫-২৬

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার এক কঠিন সময়ে গতকাল সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। প্রস্তাবিত এই বাজেটে মোটা দাগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ সামাল দিয়ে জনমনে স্বস্তি দেওয়ার একটা প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছে। তবে কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে সরকারের আয় অর্থাৎ রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে গতানুগতিকভাবে দেশীয় উৎস থেকেই বেশি অর্থের সংস্থানের কথা বলা হয়েছে। ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার সংস্থান করা হবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র থেকে। এর মধ্যে কেবল ব্যাংক খাত থেকেই নেওয়া হবে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। যেখানে বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশের নিচে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আভাস, আগামী অর্থবছরও দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের ঘরেই থাকবে। ফলে এই বাজেট কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

দেশের প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর শর্ত রয়েছে আইএমএফের। এরই আলোকে আগামী অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর আহরণে জোর দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, যার কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে করমুক্ত আয়সীমা আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে না বাড়িয়ে পরবর্তী দুই অর্থবছরে বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে তিনি। উল্টো আয়করের ৫ শতাংশের স্ল্যাব তুলে দিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন। এতে মধ্যবিত্তের করের বোঝা বাড়বে। এ ছাড়া কর ব্যবস্থা সহজ করার জন্য ৩৩ খাতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে। এতে রিটার্ন দাখিল আরও কমে যাবে বলে মনে করেন খোদ রাজস্ব আহরণকারী সংস্থার কর্মীরা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা দেশের প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থাকে আধুনিক, ন্যায্য, করদাতাবান্ধব ও বিনিয়োগবান্ধব করার ঘোষণা দেন। আর আইএমএফের চাপে এরই মধ্যে সরকার রাজস্বনীতি ও রাজস্ব বাস্তবায়ন আলাদা করে দুটি বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করেছে। যদিও আন্দোলনের মুখে বাস্তবায়নে কিছু সময় নিচ্ছেন অর্থ উপদেষ্টা। এমন বাস্তবতায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে এনবিআর থেকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের প্রস্তাব করেছেন। বর্তমান বাস্তবতায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সক্ষমতা এনবিআরের নেই বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন কালবেলাকে বলেন, ‘যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করাই হবে চ্যালেঞ্জ। আমাদের এখন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এখনো শেষ হয়নি, মাত্র চলছে। আমাদের ট্যাক্সের জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তা পূরণ করতে আমাদের সক্ষমতা নেই। এজন্য সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এনবিআরের যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো দ্রুত সমাধান করা দরকার।’

বাজেট বক্তৃতায় এলডিসি উত্তরণের অংশ হিসেবে অর্থ উপদেষ্টা শুল্ক ব্যবস্থায় বেশকিছু পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন। এতে আমদানি পণ্যের শুল্ক-কর হার পর্যায়ক্রমে হ্রাস করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সংলাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, ৬৫টি পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস, ৯টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার এবং ৪৪২টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। এর বিপরীতে বাণিজ্যিক আমদানিতে শুল্কারোপ করেছেন। এতে শুল্ক আহরণে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হতে পারে বলেই মত সংশ্লিষ্টদের। যদিও আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিত্যপণ্যের এলসি খোলার ক্ষেত্রে উৎসে করে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়েছে। তবে আইএমএফের চাপে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দেওয়া হয়েছে। আর কিছু খাতে ভ্যাটের হার বাড়িয়ে অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। এ ছাড়া ভ্যাটের অভিন্ন হারের দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।

এ ছাড়া আগামী অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে বড় নেতিবাচক পড়ার শঙ্কাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে দেশের বর্তমান বাস্তবতায় বিনিয়োগের তেমন কোনো সুযোগ না থাকায় বিষয়টি খুব বেশি নেতিবাচক হবে না বলেই অভিমত অর্থনীতিবিদদের।

এ বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালবেলাকে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় দেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুবই কম। এ ছাড়া গত কয়েক বছরের মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ খুবই কম। তাই অভ্যন্তরীণ ঋণে খুব বেশি সমস্যা হবে না।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার প্রস্তাব করেছেন। এ ছাড়া প্রকৃত বিক্রয়মূল্যে ভূমি নিবন্ধন উৎসাহিত করতে জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে উৎসে কর কমিয়েছে সরকার। আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে জমি হস্তান্তর থেকে উৎসে কর সংগ্রহের বিদ্যমান মূলধনি মুনাফা কর হার কমিয়ে এলাকা ও জমির শ্রেণিভেদে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এখন উৎসে কর দিতে হয় এলাকা ও জমিভেদে ৮, ৬ ও ৪ শতাংশ। এতে সরকারের কর কমবে বলেও মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আবাসনে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রেখে জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ কমানোতে আসলে কার লাভ বলেও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

আর কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ অব্যাহত রাখার প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলেছে, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, রাষ্ট্র সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করেছে তারা। তিনি মনে করেন, সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

অর্থ উপদেষ্টার প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে হতাশ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগ ও ব্যবসায় আশাব্যাঞ্জক কোনো পদক্ষেপ নেই। বাজেট প্রতিক্রিয়ায় এমন হতাশার কথা জানান ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, সহজে ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ উন্নয়ন, সিএমএসএমই এবং ব্যাংকিং খাত সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় সার্বিক ব্যবসা ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ততটা সহায়ক নয়।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর আয় বাড়াতে কর ধাপ সাতটি থেকে কমিয়ে ছয়টি করার প্রস্তাব করেছেন। তাতে করযোগ্য হলেই আগের চেয়ে বেশি হারে কর দিতে হবে। সার্বিকভাবে অধিকাংশ করদাতার ওপর করের চাপ বাড়বে। সর্বোচ্চ করহার আগের মতো ৩০ শতাংশ রাখা হলেও আগের ধাপগুলোর সীমা কমিয়ে আনায় গতবারের সমান আয় করেও গতবারের চেয়ে বেশি হারে কর দিতে হবে অনেক করদাতাকে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে আমরা যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছি তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বনভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। যার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হবে এ দেশের মানুষের জীবনমানের। মুক্তি মিলবে বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যেসব সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে, তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’