
বাংলাদেশের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস 'নগদের' নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকে তলবের ঘটনা নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সেই কর্মকর্তা আতিক মোর্শেদ আজ দুদকে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছেন, তবে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কি-না তা নিশ্চিত করেনি দুদক।
নগদ-এর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার কথা রোববার জানিয়েছিলো দুদক। এছাড়া ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণসহ মি. মোর্শেদ ও তার স্ত্রীকে আজ দুদকে ডাকা হয়েছিলো।
এর আগে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাদেরকে সম্প্রতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার ঘটনাগুলোয় উপদেষ্টা কিংবা যার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে এসব ব্যক্তিরা কাজ করেছেন, তার দায় এড়ানোর সুযোগ আছে কি-না।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, কোনো এপিএস বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দুর্নীতির দায় তিনি যার সাথে কাজ করেন, সেই মন্ত্রী বা উপদেষ্টার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
তাই এ ধরনের অভিযোগ উঠলে যথাযথ তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।
দুদকের মুখপাত্র আখতারুল ইসলাম বলছেন, কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানের সময় তাতে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতার তথ্য আসলে তিনি যেই হোন না কেন, তাকে অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়।
বাংলাদেশে এর আগে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই তার একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি করে ৪০০ কোটি টাকা অর্জনের তথ্য প্রকাশের পর।
ওই কর্মকর্তা তার আগে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন। এছাড়াও বিগত সরকারের মন্ত্রীদের এপিএস ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই তখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও এসব ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ নেই বললেই চলে।
আলোচিত যত অভিযোগ
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন গত সাতাশে এপ্রিল জানিয়েছিলেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) তুহিন ফারাবীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু করেছেন তারা।
এর আগে ২২শে এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মোয়াজ্জেম হোসেন ও তুহিন ফারাবীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
সম্প্রতি দুদকের আবেদনের পর মোয়াজ্জেম হোসেনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে তার জাতীয় পরিচয়পত্র ব্লক করা হয়েছে।
মি. হোসেনের বিষয়ে আদালতে দুদক যে আবেদন করেছে, তাতে বলা হয়েছে " মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, তদবির বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে"।
বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হলে আসিফ মাহমুদ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছিলেন, "অভিযোগ ও গুঞ্জন উঠলে আমি নিজেই দুদককে বিষয়টি অনুসন্ধানের অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আমার সাবেক এপিএস সংক্রান্ত অনুসন্ধানে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা করতেও নির্দেশ দিয়েছি"।
এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন কর্মীকে রেলওয়ের কিছু দায়িত্ব দেওয়া এবং তাদের বিশেষ কিছু সুবিধার বিষয়টিও ব্যাপক আলোচনায় এসেছিলো। ওই তিনজনের বিরুদ্ধে এসব সুবিধার অপব্যবহার, এমনকি টিকেট কালোবাজারির মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছিলো।
সবশেষ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আতিক মোর্শেদের বিরুদ্ধে নগদের দেড়শ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ও তার স্ত্রীকে নগদে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি দেওয়া নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
মি. মোর্শেদ সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া পোস্টে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন তার স্ত্রী যোগ্যতার ভিত্তিতেই নগদে চাকরি পেয়েছেন।
যদিও দুদক বলেছে, তারা প্রাথমিকভাবে এ নিয়োগ নিয়ে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব শনিবার তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, "আমার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট (স্বার্থের সংঘাত) এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এসেছে। কাজটা ঠিক হয়নি—এটা আমি বিনা বাক্যে স্বীকার করছি। তাঁকে প্রচণ্ডরকম বকাবকিও করেছি। উনার বউকে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি আমি তদন্তের ব্যবস্থা করেছি, নির্দেশনা দিয়েছি"।
মি. মোর্শেদ এর আগে সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সাথেও কাজ করেছেন। ফলে দেড়শ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল মি. ইসলামের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব অবশ্য লিখেছেন এ বিষয়ে তার ও নাহিদ ইসলামের নাম অন্যায়ভাবে জড়ানো হয়েছে।
উপদেষ্টা দায় এড়াতে পারেন?
সরকারের যেসব উপদেষ্টা বা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিলে বা দুদককে তদন্ত করতে বলার মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা বা বিশেষ সহকারীর দায় শেষ হয় কি-না, এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
কারণ সাধারণ মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা নিজেদের ঘনিষ্ঠ কাউকে নিজেদের ব্যক্তিগত পছন্দের নিরিখে এসব পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। ফলে তাদের কর্মকাণ্ডের দায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা উপদেষ্টাকেই নেওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন।
দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বা এপিএস পদে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তি পছন্দের নিয়োগ কতটা অপরিহার্য ও গ্রহণযোগ্য সেটাই বড় প্রশ্ন। বিশেষ করে যেভাবে এ পদে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে।
"এরপর এসব পদের ব্যক্তিরা কোনো মন্ত্রী বা উপদেষ্টার সাথে কাজ করার সময় কোনো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে সেই দায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা উপদেষ্টাও এড়াতে পারেন না। বরং অভিযোগ উঠলে স্বচ্ছ তদন্তের স্বার্থে তাদেরই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত। এটিই সংস্কৃতি হওয়া উচিত," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে, এপিএস বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বন্ধু, পূর্ব পরিচিত, সহযাত্রী, পরিবারের সদস্য এমন ব্যক্তিদের নিয়োগের যে সংস্কৃতি তা অন্তত এই "নতুন বাংলাদেশে" রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব পাওয়া সরকারের সময়ে আশা করা হয়েছিলো।
"কিন্তু এ প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া দু:খজনক," বলেছেন তিনি।
অন্যদিকে দুদকের মুখপাত্র আখতারুল ইসলাম বলছেন, দুদক কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর তা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। "সেই অনুসন্ধানে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়াও অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পেলে তাকেও অনুসন্ধানের আওতায় এনে কাজ করে থাকে। দুদক এক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেয় না, তিনি যেই হোন না কেন," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।