Image description
নগরভবন খুলবে কবে? চ্যালেঞ্জে পড়বে কুরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ * সেবাবঞ্চিত করে আন্দোলন দায়িত্বশীল কাজ হতে পারে না -ড. ইফতেখারুজ্জামান

সতেরো দিন ধরে বন্ধ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয়সহ ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়। এতে ভেঙে পড়েছে নগর সেবা কার্যক্রম। ওয়ার্ড কার্যালয়ের মাধ্যমে জোড়াতালি দিয়ে বর্জ্য অপসারণসহ জরুরি কিছু সেবা সচল রাখা হয়েছে। বলা চলে ‘লাইফ সাপোর্টে’ চলছে সেবা কার্যক্রম। সড়ক বাতি প্রজ্বালন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন, মশার ওষুধ ছিটানোসহ প্রায় ৩০ ধরনের সেবাই ব্যাহত হচ্ছে। ভুক্তভোগী ও ডিএসসিসি সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানান।

তারা বলেন, অফিস বন্ধ থাকায় সব ধরনের সেবা ব্যাহত হচ্ছে। জন্ম-মৃত্যু ও তালাক নিবন্ধন, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিল তুলতে পারছে না। সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর বিল জুনের মধ্যে দিতে না পারলে তা সরকারি কোষাগারে ফেরত গেলে জটিলতা বাড়বে ডিএসসিসির। কুরবানি বর্জ্য অপসারণের জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, তা নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। কুরবানির হাট ব্যবস্থাপনাসহ সেবা স্বাভাবিক করতে নগরভবন খুলে দেওয়া প্রয়োজন হলেও কবে খুলবে তা কেউই বলতে পারছে না।

বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে মেয়রের শপথ পড়ানোর দাবিতে ডিএসসিসি নগরভবন তালাবদ্ধ করে দিয়েছেন তার সমর্থকরা। গত ১৪ মে তারা আন্দোলন শুরু করে ১৫ মে নগরভবনসহ ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় রোববার ডিএসসিসির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য বরাদ্দ ৫ বছরের সময়সীমা শেষ হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, যে কারোরই আন্দোলন করার অধিকার রয়েছে। সাময়িক হলে অফিস বন্ধ করেও আন্দোলন করা যায়। কিন্তু দিনের পর দিন অফিস বন্ধ করে আন্দোলন করা ঠিক নয়। তিনি জানান, আন্দোলনকারীদের বিকল্প খুঁজে নিতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে আন্দোলন করা হচ্ছে, ওই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের সেবাবঞ্চিত করে আন্দোলন দায়িত্বশীল কাজ হতে পারে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দীন হাসান যুগান্তরকে বলেন, দাবি-দাওয়া যৌক্তিক উপায়ে করতে হবে। আবার যাদের কাছে দাবি জানানো হবে, তাদেরও তা বিবেচনা করতে হবে। তবে নগরভবন বন্ধ করে যেভাবে আন্দোলন চলছে; নাগরিক সেবা বিবেচনা করে আন্দোলনকারীদের বিকল্প কিছু ভাবতে হবে।

ব্যাহত ডিএসসিসির সেবা : সিটি করপোরেশনের সেবার পরিমাণ ৩০ বা তার চেয়েও বেশি। আনুষ্ঠানিক সেবার পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিকও বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে ডিএসসিসি। গুরুত্বপূর্ণ সেবার তালিকায় রয়েছে-সড়কের বৈদ্যুতিক বাতি, হাসপাতাল, রাস্তা-নর্দমা-ফুটপাত উন্নয়ন ও সংস্কার, বাজার ব্যবস্থাপনা, জন্ম-মৃত্যু-তালাক নিবন্ধন, মশক নিধন, আবর্জনা পরিষ্কার, কবর বা সৎকার, ব্যায়ামাগার, কমিউনিটি সেন্টার, মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, সড়কে পার্কিং, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা, গ্রন্থাগার, সংগীত ও স্কুল, বাস টার্মিনাল, পাবলিক টয়লেট, পার্ক এবং খেলার মাঠ ইত্যাদি।

রোববার ডিএসসিসির এক নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, আন্দোলনের নামে নগরভবন তালা মেরে রাখা কোনোভাবেই যৌক্তিক হচ্ছে না। এতে সেবা ও উন্নয়ন কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা এই ধরনের আন্দোলন চান না।

ডিএসসিসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিদিন নগরভবনের প্রধান কার্যালয়সহ অঞ্চলগুলোতে অন্তত ১০ হাজার মানুষ আসেন সেবা নিতে। কুরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে ডিএসসিসি এলাকার অস্থায়ী পশুর হাট ব্যবস্থাপনা ও কুরবানি পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এক বড় চ্যালেঞ্জ। সেসব মোকাবিলায় যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল তা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এজন্য তারা দ্রুত এই আন্দোলনের অবসান চান।

রাজস্ব বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, নাগরিক সেবার পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আগে নাগরিকরা ভবনে গিয়ে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতেন। আন্দোলনের কারণে তারা দিতে পারছেন না। নগরভবনে থাকা দুটি আঞ্চলিক কার্যালয়ের নতুন ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, নবায়ন, জন্ম-মৃত্যু-তালাক নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদসহ সব কাজই বন্ধ। নগরভবনের বাইরের ৮টি আঞ্চলিক কার্যালয় বন্ধ থাকায় সেখানেও কোনো সেবা মিলছে না।

এদিকে রোববারও বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে নগরভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন দলটির নেতা-সমর্থকরা। সেই সঙ্গে ভবনের মূল ফটকসহ সব নাগরিক সেবা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝোলানো হয়েছে। কর্মবিরতিতে রয়েছেন নগরভবনের শ্রমিক ও কর্মচারীরা। ফলে সব ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে স্লোগানে স্লোগানে মিছিল নিয়ে নগরভবনে জড়ো হতে থাকেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। পরে তারা মূল ভবনের নিচে অবস্থান নেন। এতে নগরভবন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ সময় ‘ইশরাক তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘ইশরাকের শপথ নিয়ে টালবাহানা মানব না, মানব না’, ‘ইশরাক ভাই এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সঙ্গে’ ইত্যাদি নানা স্লোগান দেন আন্দোলনকারীরা।

আন্দোলনকারীদের বক্তব্য : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জাতীয়তাবাদী শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুজ্জামান তুহিন যুগান্তরকে বলেন, অফিস বন্ধ করে আন্দোলন তারাও পছন্দ করছেন না। তবে পরিস্থিতির কারণে তারা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। সেবা নিশ্চিত করতে দ্রুত নগরভবনের তালা খুলে দেওয়া উচিত।

ইশরাক সমর্থকদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক সচিব মশিউর রহমান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, নগরভবন বন্ধ করে আন্দোলনে নগরবাসীর দুর্ভোগ হচ্ছে এটা সত্য। তবে এটা আনুষ্ঠানিকভাবে তারা করেননি। এটা নগরবাসী করেছে। তারা মনে করছেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কৌশলও পরিবর্তন হবে।

এ বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের মতামত জানতে তার ব্যক্তিগত নম্বরে এবং ঘনিষ্ঠজনদের একাধিকবার কল করেও কোনো মতামত জানা সম্ভব হয়নি।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নগরভবন বন্ধ রাখার বিষয়টি রাজনৈতিক ও আইনগত বিষয়। নগরভবন ও আঞ্চলিক অফিসগুলো বন্ধ থাকায় সেবা কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়টি মৌখিক ও লিখিতভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানানো হয়েছে। সেখান থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ডিএসসিসির অনেক কর্মচারীও অংশ নিয়েছে। যেটা তারা নিতে পারেন না। তাদের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। সে সুযোগ রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্তব্য আইন মেনে কাজ করা উচিত।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বক্তব্য জানতে চেষ্টা করেও তা পাওয়া যায়নি।