Image description
চলতি অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটে শেষ মুহূর্তে খরচের হিড়িক পড়েছে। তড়িঘড়ি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপচয় হতে পারে-এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, বছরের পর বছর একই চিত্র বিরাজ করলেও এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না। বিগত কোনো সরকারই এ ব্যাপারে নেয়নি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। এভাবেই সরকারি অর্থ অপচয় করা যেন স্থায়ী অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যদিও আগামী অর্থবছর থেকে এ বিষয়ে পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে বলে সম্প্রতি যুগান্তরকে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

চলতি অর্থবছরের শেষ দুই মাসে (মে-জুন) এক লাখ ৩২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা ব্যয় করার ঝুঁকি নিয়েছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। অথচ গত ১০ মাসে খরচ হয়েছে মাত্র ৯৩ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ। সেখানে এত বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করতে হবে মাত্র দুমাসেই। ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে দুই লাখ ২৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) বিভিন্ন সময় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এ প্রসঙ্গে যুগান্তরের এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি বলেন, হ্যাঁ এটা একটি বড় সমস্যা। এক্ষেত্রে আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মানসিকতাও কিছুটা দায়ী। কেননা অর্থবছরের শুরু থেকে টাকা ছাড় না দিয়ে পরে ছাড় করা হয়। ফলে প্রথমদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসে না। তবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) যাতে শুরু থেকেই বাস্তবায়ন কাজ দ্রুত করা যায়, সে লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে।

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, সাধারণত বিল পরিশোধের প্রক্রিয়াগত কারণে কিছুটা সময় লাগতে পারে, সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতি অর্থবছরে যেভাবে শেষ দুই-তিন মাসে অর্থনৈতিক অগ্রগতি দেখানো হয় সেটি অবশ্যই সন্দেহজনক। এক্ষেত্রে ঠিকাদাররা বিল তুলে নেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করতে চায়। ফলে কাজের মান ঠিক থাকে না। আবার কাজ না করেও অনেক ঠিকাদার বিল তুলে নেন। এই দুক্ষেত্রেই ঠিকাদাররা বিল পরিশোধকারী কর্মকর্তাদের ঘুস দিয়ে কাজের অগ্রগতি ঠিক আছে বলে সার্টিফিকেট নিয়ে নেয়। এভাবে শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে কাজের নামে দুর্নীতি ও অনিয়ম করা হয়। সেই সঙ্গে অপচয় তো আছেই। অর্থবছরের শেষে টাকা তুলে নেওয়ার অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাটা জরুরি। এমন সন্দেহজনক ব্যয়ের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থাও নেওয়া দরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১০ মাসে সংশোধিত এডিপির খরচ হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা বা ৪৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। সেখানে মাত্র দুই মাসে (মে-জুন) খরচ হয়েছিল ৮০ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে মোট ব্যয় হয় ২ লাখ ৫ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ মাসে খরচ হয়েছিল এক লাখ ১৯ হাজার ৬৪ কোটি টাকা বা ৫০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সেখানে শেষ দুই মাসে ব্যয় হয় ৯৭ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরের মোট ব্যয় হয়েছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। এটি মোট সংশোধিত এডিপির ৮৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে খরচ হয় এক লাখ ১৯ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা বা ৫৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। সেখানে শেষ দুই মাসে ব্যয় হয় ৮৩ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। মোট সংশোধিত এডিপির ব্যয় হয়েছিল দুই লাখ তিন হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা বা ৯২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করে এক লাখ দুই হাজার ৭৩০ কোটি টাকা বা ৪৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। শেষ দুই মাসে ব্যয় হয় ৬৯ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে মোট ব্যয় হয়েছিল এক লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা বা সংশোধিত এডিপির ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ।

পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্য (সচিব) রোববার যুগান্তরকে বলেন, এ রকম হওয়ার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণও আছে। যেমন দরপত্র প্রক্রিয়া করতে অনেক সময় লেগে যায়। এছাড়া অর্থবছরের প্রথমদিকে রাজস্ব আদায় কম থাকে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ধীরে টাকা ছাড় করে। পাশাপাশি দেখা যায়, অনেক প্রকল্পে ভৌত কাজ হয়তো হয়ে যায় কিন্তু শেষদিকে দুই বা তিন কিস্তির বিল একবারেই পেমেন্ট করা হয়। ফলে শেষদিকটা অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে মনে হয়। তবে কিছু অযৌক্তিক কারণও আছে। এ অবস্থা বছরের পর বছর ধরে চলাটা ঠিক নয়। এতে মানুষের পারসেপশন (ধারণা) খারাপ হয়ে গেছে। মানুষ ভাবছে শেষ সময়ে তড়িঘড়ি কাজ করতে গিয়ে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি হচ্ছে। মানুষের এই ভাবনা দূর করতে হবে। আগামী অর্থবছর থেকে এক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আনতে হবে। যেন শুরু থেকেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কর যায়।