
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম এবং বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট পেশ আজ। বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আগামী (২০২৫-২৬) অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থনীতির কোনো সূত্র না মেনেই প্রতি বছর বাড়ানো হতো বাজেটের আকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্যও রেকর্ড ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। এদিকে বাজেট বক্তৃতার পরপরই সংশ্লিষ্ট সব বাজেটের তথ্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিবরণীতে এ তথ্য জানা গেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগে আস্থা ফেরানো, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। এ ছাড়া সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে জ্বালানি খাতে দাম সমন্বয়ের প্রক্রিয়া ও ভর্তুকি পুনর্বিন্যাস থাকছে, সেই সঙ্গে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে নীতিগত কাঠামো শক্ত করা হবে।
এক নজরে: সরকার বাজেটের আবার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। এদিকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, এনবিআর কর রাজস্ব লক্ষ্য ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব লক্ষ্য ১৯ হাজার কোটি টাকা, করবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৪৬ হাজার কোটি টাকা, অনুন্নয়ন ব্যয় ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, এডিপি’র লক্ষ্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। আর জিডিপি’র লক্ষ্য ৫.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করতে যাচ্ছে।
বাজেটে কার জন্য কি থাকছে: কিছু খাতে করছাড় দেয়া হলেও যেসব খাতে বাড়ানো হচ্ছে, তার সবই জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এতে বাড়ছে আয়কর হার, তুলে নেয়া হচ্ছে স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট ও কর-অব্যাহতি, যা উৎপাদন খাতে চাপ বাড়াবে। বিপরীতে, শুল্কনীতির সংস্কারে ৬২৬টি পণ্যের শুল্ক হ্রাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপ মোকাবিলায় আরও ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে, যা বিদেশি পণ্যের প্রবাহ বাড়িয়ে দেশীয় শিল্পকে আরও চাপে ফেলবে। ফলে এখানে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে।
এদিকে বাজেটে মূল প্রস্তাবগুলোর মধ্যে থাকছে ৬২২ পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক তুলে নেয়া বা কমানো এবং বাণিজ্য বাড়াতে আরও ১০০ পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কমানো। এরমধ্যে আছে হিমাগারের যন্ত্রপাতি, কাগজের পণ্য, বাস, নিউজপ্রিন্ট, ক্যান্সারের চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং ওষুধ ও পরিবেশবান্ধব পণ্যের কাঁচামাল। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ও ওষুধের কাঁচামালে শুল্ক ছাড় দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে আমদানিতে ভুল ঘোষণার জরিমানা বর্তমানের ৪০০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০০ শতাংশ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ওদিকে বাজেটের কর খাতে কিছু হেরফের হচ্ছে। যেমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর কিছুটা কমবে। জমি কেনাবেচায় কর কমানো হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হতে পারে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কর বাড়তে পারে। পুঁজিবাজারে অনিবন্ধিত কোম্পানির ক্ষেত্রে বাড়বে করপোরেট করহার।
হিমাগারে সুবিধা: কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ও ফসল কাটার পর লোকসান কমাতে হিমাগারের যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক মওকুফ করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ ছাড়া খেলনা ও ক্রিকেট ব্যাট উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ক্ষেত্রেও শুল্ক কমানোর সম্ভাবনা আছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমদানি করা ফিনিশড টয়গুলোর শুল্ক প্রতি কেজি চার ডলার ও ক্রিকেট ব্যাট তৈরিতে ব্যবহৃত উইলো কাঠের শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৬ শতাংশ করা হতে পারে।
এদিকে যানজট দূর করার লক্ষ্যে ১৬-৪০ আসনের বাসের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। একইভাবে মাইক্রোবাসের (১০-১৫টি আসন) সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
চিনির আমদানি শুল্ক: দেশে উৎপাদিত চিনির দাম স্থিতিশীল রাখতে ও রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক টনপ্রতি সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে কমিয়ে চার হাজার টাকা করতে পারে।
সফটওয়্যার রপ্তানিতে উৎসাহ: দেশে তৈরি সফটওয়্যার রপ্তানি বাড়াতে সরকার ডেভেলপমেন্ট টুলস, অপারেটিং সিস্টেম, ডাটাবেজ ও সিকিউরিটি সফটওয়্যারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করতে পারে।
বিলাসবহুল পণ্যে শুল্ক: অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের শুল্ক কমানোর পাশাপাশি সরকার কয়েকটি বিলাসবহুল পণ্যের শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। যেমন, লিপস্টিক ও ফেসওয়াশের ন্যূনতম শুল্ক দ্বিগুণ বাড়িয়ে প্রতি কেজি ৪০ ডলার করা হতে পারে। পাশাপাশি চকলেটের ক্ষেত্রেও শুল্ক বাড়তে পারে।
হেলিকপ্টার আমদানিতে শুল্ক: আমদানি করা হেলিকপ্টারের শুল্ক এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগে পরিবহন ও জরুরি প্রয়োজনে হেলিকপ্টারের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসা ও পরিষেবার খরচ বাড়তে পারে।
এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট ছাড়: বাজেটে এলএনজি আমদানিতে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে (ভ্যাট) ছাড় দেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কারখানার জ্বালানি খরচ কমাতে সহায়তা করবে।
করপোরেট ও আয়করে পরিবর্তন: রাজস্ব বাড়াতে সরকার ধনীদের আয়করের হার ৩০ শতাংশ করে বেশ কয়েকটি আয়করের সমন্বিত ব্যবস্থা চালু করতে পারে। গতিশীল কর কাঠামো চালু করে অন্যান্য আয়কর হার সামঞ্জস্য করা হতে পারে।
এ ছাড়া দাম বাড়তে পারে- মাখন, তারকাঁটা, সব ধরনের স্ক্রু, নাট-বোল্ট, ইলেকট্রিক লাইন হার্ডওয়্যার, পোল ফিটিংস, সেল্ফ কপি পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড/কোটেড পেপার, প্লাস্টিকের তৈরি ওয়ান টাইম গ্লাস, বাটি, প্লেট ইত্যাদি; তামাক বীজ, মোটরসাইকেল ও সাইকেলের যন্ত্রাংশ, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের ফুড সাপ্লিমেন্ট, বেভারেজ আইটেম, দরজার তালা ইত্যাদি।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তার প্রথম বাজেটে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়ার জন্য বরাদ্দ রাখছেন।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এবারের বাজেটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং কাঠামোগত রূপান্তরকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের ওপর রাজস্ব আয় বৃদ্ধির চাপ রয়েছে। সেজন্য প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সরেট বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের কৌশল হিসেবেও ধীরে ধীরে করছাড় তুলে নিতে হবে। তবে এর সঙ্গে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতির বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার যদি পুরনো ছকে একটু এদিক-সেদিক করে বাজেট করে, তাহলে আশাহত হবো। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের জন্য একটি উদাহরণ তৈরি করার সুযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে ছিল। এক্ষেত্রে সময়ের অভাবের অজুহাত দেয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ সরকার ৯ মাস সময় পেয়েছে।