Image description

ঢাকা সেনানিবাসের স্টাফ রোড এলাকায় জেনারেলদের বাসস্থান হিসেবে পরিচিত ‘নক্ষত্র ভবন’ লাগোয়া ২০৮ নম্বর বাড়িটি ছিল মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাশিমবাজার কুঠি। ওই বাড়ি থেকেই তারিক সিদ্দিক সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। কখন কাকে গুম করতে হবে, গুমের পর খুন করতে হবে, গুম করে কাকে আয়নাঘরে নিতে হবে, বিচারবহির্ভূত হত্যা করতে হবেÑসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো ওই বাড়িতে। তারিক সিদ্দিক গুম-খুন ও আয়নাঘরের কারিগর হিসেবে চিহ্নিত। শুধু এসবই নয়, প্রতিরক্ষা ক্রয়ের (ডিফেন্স পারচেজ) কাজ কে পাবে, ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে কীভাবে, বিমানবন্দরের ব্যবসা, সশস্ত্র বাহিনীর রেশনের কমিশন, ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা ও প্রতিষ্ঠান দখল, বড় বড় প্রকল্পের কমিশনÑসবই নির্ধারণ করা হতো ওই বাড়িতে। তেমনি সশস্ত্র বাহিনীর বদলি-পদোন্নতিও নির্ধারণ করা হতো এখান থেকেই।

তারিক সিদ্দিক শেখ রেহানার দেবর। শেখ জামালেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই আত্মীয় ও বিশ্বস্ত হিসেবে তাকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা করেন। তার অপকর্ম সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তারিক সিদ্দিকের সাংকেতিক নাম ‘জিটি’ অর্থাৎ জেনারেল তারিক। সেনা অফিসারদের কাছে এই সাংকেতিক নামেই তারিক সিদ্দিক পরিচিত ছিলেন। সেনা কর্মকর্তারা উপহাস করেই তাকে জিটি ডাকতেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর তার স্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ক্যান্টনমেন্টের মঈনুল রোডের বাড়িটি বৈধভাবে দেওয়া হয়েছিল। ওই বাড়িতে ৩৮ বছর বসবাসের পর তাকে উচ্ছেদ করা হয়। অথচ বাড়িটি ছিল জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত। কর্নেল হিসেবে বাড়িটি বরাদ্দ পান জিয়া। সেনাপ্রধান হওয়ার পরও জিয়া ওই বাড়িতেই থাকতেন। সেনাপ্রধানের জন্য নির্ধারিত বাসভবনে যাননি। এমনকি রাষ্ট্রপতি হিসেবেও তিনি ওই বাড়িতেই ছিলেন।

ক্যান্টনমেন্টে সিভিলিয়ান বা বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে খালেদা জিয়া থাকতে পারবেন নাÑএমন অজুহাতে তাকে উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদের পরপরই বাড়িটি ভেঙে সেখানে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তারিক সিদ্দিক একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সিভিলিয়ান হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সব নীতিমালা ভঙ্গ করে তাকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তিনি সেখানে থাকেন বছরের পর বছর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারিক সিদ্দিককে প্রথমে সেনানিবাসের ‘মুরিং হাউস’-এ থাকার জন্য বাড়িটি বরাদ্দ করা হয়। এরপর ২০৮ নম্বর বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হলে বাড়িটি তাকে দেওয়া হয়।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর যে বাড়িগুলো আছে তা স্টেশন হেডকোয়ার্টার থেকে দেখাশোনা করা হয়। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর আবাসিক অ্যাকোমোডেশনের দায়িত্ব স্টেশন হেডকোয়ার্টারের। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে স্টেশন হেডকোয়ার্টার থেকে তারিক সিদ্দিককে ‘মুরিং হাউস’-এ থাকতে দেওয়া হয়। সরেজমিন ‘মুরিং হাউস’ ও ২০৮ নম্বর বাড়িটি এই প্রতিবেদক দেখে আসেন। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ও সেনাপ্রধানের বাসভবনের সামনে তিনটি বাড়ি রয়েছে। ‘এয়ার হাউস’ অর্থাৎ বিমানবাহিনী প্রধানের বাসভবন, ‘মুরিং হাউস’ অর্থাৎ নৌ বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধানের বাসভবন এবং ‘পথিকৃৎ’ অর্থাৎ সেনাপ্রধান এলপিআর-এ গেলে যে বাড়িতে থাকবেন, সেটি। এই তিনটি বাড়ির একটি মুরিং হাউসে নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে প্রথম দিকে থাকতেন মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক। বেশ লম্বা সময় তিনি ওই বাড়িতে ছিলেন। নতুন করে নির্মাণের আগে স্টাফ রোডের ২০৮ নম্বর বাড়িতে থাকতেন ডিজি ডিএফআই। ওই বাড়ি ভেঙে তৈরি করা হয় অত্যাধুনিক নতুন বাড়ি। এটি নক্ষত্র বিল্ডিং লাগোয়া। বিমানবন্দর থেকে এসে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে গেলে রেললাইন পার হয়ে হাতের ডান পাশেই ২০৮ নম্বর বাড়িটি। এর পাশেই নক্ষত্র ভবন। নক্ষত্র ভবনের ফ্ল্যাটগুলোয় থাকেন মেজর জেনারেল ও লে. জেনারেল পদবির সেনা কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তারিক সিদ্দিকের জন্য ২০৮ নম্বর বাড়িটি আধুনিক প্রযুক্তির সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন করে নির্মাণ ও সাজানো হয়। নক্ষত্র ভবনের পাশের এ বাড়িতে তারিক সিদ্দিককে রাখার কারণ ছিল জেনারেলদের নিয়ন্ত্রণ এবং চোখে চোখে রাখা। অর্থাৎ তারিক সিদ্দিক তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রভাব বলয় এস্টাবলিস্ট করতেই ওই বাড়িতে থাকেন। একই সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি অনেক কর্মকর্তাকে ‘র’-এর সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া হতো এ বাড়িতে। তারিক সিদ্দিক ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একজন বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। ক্যান্টনমেন্টে ‘র’-এর আস্তানা হয় তার মাধ্যমে। ক্যান্টনমেন্টপাড়ায় তাকে বাংলাদেশে ভারতের প্রকৃত হাইকমিশনার বলে ট্রল করা হতো। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কে এতটাই সার্ভ করতেন, যার ফলে তাকে এটা বলা হতো। ২০৮ নম্বর বাড়িটিতে ব্যবসার দেনদরবার এবং কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টিও ঠিক হতো। বড় বড় ব্যবসায়ীকেও এ বাড়িতে ডাকা হতো।

বড় গুমগুলোর পেছনে ছিলেন তারিক সিদ্দিক

গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত বহু অপকর্মের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তাকে আয়নাঘরের কারিগরও বলা হয়। চাঞ্চল্যকর গুমগুলো তার মাধ্যমেই হয়েছে। তারিক সিদ্দিক ইলিয়াস আলী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল হাসিন, রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্রিগেডিয়ার আজমী, ব্যারিস্টার আরমান, চৌধুরী আলমসহ বড় গুমগুলো করিয়েছেন। বেশিরভাগ কাজ করিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানকে দিয়ে। তারেক সিদ্দিকের ডানহাত হিসেবে কাজ করেছেন জিয়াউল আহসান। রিমান্ডে জিয়াউল তা স্বীকারও করেছের।

গুম কমিশন সূত্রে জানা গেছে, কমিশন দেড় হাজারের বেশি গুমের অভিযোগ পেয়েছে। এসব অভিযোগে গুমের জন্য তারিক সিদ্দিককে দায়ী করেছেন অনেক ভুক্তভোগী। এসব অভিযোগ তদন্ত করে গুম কমিশন গুমের পেছনে যে তারিক সিদ্দিক দায়ী, তার বহু প্রমাণ পেয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও (আইসিসি) দুটি মামলায় তারিক সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় তারিক সিদ্দিকের ভূমিকা ছিল হিংস্র প্রকৃতির। তিনি ৪ আগস্ট গণভবনে শেখ হাসিনার সামনে বিমান বাহিনীর প্রধানকে হেলিকপ্টার দিয়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাতে বলেছিলেন। এতে বিমান বাহিনীর প্রধান ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘আপনাকে এই লোকই ডুবিয়েছে। এই লোকই আপনার সর্বনাশ করছে এবং আরো করবে।’

পিলখানায় বিডিআর ম্যাসাকারে ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা হত্যার পেছনেও শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

তারিক সিদ্দিকের উত্থান

সেনাবাহিনীর চাকরি শেষে তারিক সিদ্দিক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টার কোনো পদ আগে ছিল না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারিক সিদ্দিকের জন্য পদটি সৃষ্টি করেন। প্রথমে তিনি ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায়। কিন্তু ২০০৯ সালের পর নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদটি মন্ত্রীর মর্যাদায় করা হয়। এর আগে ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দিয়ে তারিক সিদ্দিককে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। শেখ জামালের সঙ্গে পরিচয় এবং শেখ রেহানার দেবর হিসেবে আত্মীয়তার সূত্রে তারিক সিদ্দিক শেখ হাসিনার খুব কাছাকাছি চলে যান। তিনি সেকেন্ড বিএমএ শর্ট সার্ভিস (এসএস-২) কমিশনের একজন অফিসার ছিলেন। শেখ জামালও ওই সময় যুক্তরাজ্য থেকে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আসেন এবং তারিক সিদ্দিক তার ঘনিষ্ঠ হন। শেখ হাসিনা তাকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা করার কারণ ছিল সশস্ত্র বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। সশস্ত্র বাহিনীর যে কোনো ফাইল তার মাধ্যম হয়ে যেতে হতো। এতে বাহিনীর প্রধানদের আন্ডারমাইন করা হতো। তারিক সিদ্দিক নিজেকে সশস্ত্র বাহিনীর অঘোষিত প্রধান ভাবতেন। নিরাপত্তা উপদেষ্টার অফিস একটি প্যারালাল মন্ত্রণালয় হিসেবে কাজ করত তখন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রমোশন, বদলি, পদায়ন তারিক সিদ্দিক যেভাবে বলতেন সেভাবে হতো। ২০০৯ সালের পর তারিক সিদ্দিক নিরাপত্তা উপদেষ্টা হয়ে সশস্ত্র বাহিনীর ‘বঞ্চিত’-দের জন্য বোর্ড গঠন করেন। এরপর তারিক সিদ্দিক পদোন্নতির মাধ্যমে নিজস্ব একটি বেনিফিশিয়ারি গ্রুপ তৈরি করেন। ভূতাপেক্ষা পদোন্নতির মাধ্যমে তৎকালীন ডিজি এনএসআই জেনারেল মঞ্জুর ও জেনারেল জিয়া (মৃত) পদোন্নতি পান। অর্থাৎ একটি প্রভাব বলয় তৈরি করেন তারিক সিদ্দিক।

১৯৯৬ সালের পর মিগ-২৯, ফ্রিগেট বিএনএস বঙ্গবন্ধু ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতির বিষয়ে দুদকে মামলা হয়। ওই মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে তারিক সিদ্দিকও ছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ওই মামলাও ক্লিয়ার করে নেওয়া হয়। ডিরেক্টর জেনারেল ডিফেন্স পারচেজ (ডিজিডিপি) সব সময় তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। ফলে ডিফেন্স পারচেজের অস্ত্র-গোলাবারুদসহ যাবতীয় সামরিক সরঞ্জাম কেনাকাটার কমিশন তিনি পেতেন। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর যাবতীয় রেশনের কমিশনও তারিক সিদ্দিক পেতেন। প্রতি কেজি চাল থেকে এক টাকা, ডাল থেকে দুই টাকা হারে নিতেন বলে সূত্র জানায়। এতে বছরে ৬০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকা কমিশন পেতেন তারিক সিদ্দিকের সিন্ডিকেট। বিষয়গুলো ক্যান্টনমেন্টে সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের কাছে ওপেন সিক্রেট আলোচনার বিষয় ছিল।

তারিক সিদ্দিকের মাধ্যমে ‘র’-এর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান

তারিক সিদ্দিকের বড় অপকর্ম দেশকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর হাতে তুলে দেওয়া। নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি শনাক্ত করে তা মোকাবিলা করা যেখানে তার কাজ হওয়া উচিত ছিল, সেখানে নিজেই হুমকি হয়ে ওঠেন। ভারতের হাতে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা তুলে দেওয়া ছিল বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্য।

নিজস্ব একটি টিম নিয়ে তারিক সিদ্দিক অপকর্মগুলো করেন। এই টিমের সদস্যরা হলেনÑলে. জেনারেল মুজিব, লে. জেনারেল জিয়াউল আহসান, মেজর জেনারেল জোবায়ের (সাবেক এনএসআই ডিজি), মেজর জেনারেল হামিদ, মেজর জেনারেল আকবর হোসেন, লে. জেনারেল মামুন খালেদ, লে. জেনারেল মোল্লা ফজলে আকবর এবং লে. জেনারেল তাবরেজ শামস। এরা শেখ হাসিনা, তারিক সিদ্দিক ও ভারতীয় ‘র’-এর অনুগত কর্মকর্তা হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী মহলে পরিচিত ও আলোচিত।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে আরো জানা গেছে, ভারতীয় ‘র’-কে ঢাকা সেনানিবাসে প্রবেশ করানোর দুঃখজনক দেশবিরোধী কাজটি করেন তারিক সিদ্দিক ও তৎকালীন ডিজিএফআই চিফ লে. জেনারেল মোল্লা ফজলে আকবর।

সূত্র জানায়, ‘র’-এর জন্য ডিজিএফআইয়ের কচুক্ষেত সদর দপ্তরের দুটি ফ্লোর অলিখিতভাবে বরাদ্দ ছিল। ওই দুই ফ্লোরে ডিজিএফআইয়ের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যেতে পারতেন না। ‘র’ ক্যান্টনমেন্টে বসেই আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ও সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। ‘র’-এর অতিবিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে তারিক সিদ্দিক তার ২০৮ নম্বর বাড়িতে বসে দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে মেতে থাকতেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা, ভারতের স্বার্থ বাস্তবায়ন এবং আখের গোছানোই ছিল তাদের প্রধান কাজ।

এনএসআইয়ের আর্মি উইং

একই ভাবে জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক সেনানিবাস এলাকায় এনএসআইয়ের আর্মি উইংও গড়ে তোলেন। এ উইংয়ের তিনটি অফিস ছিল। একটি সেনানিবাসের ভেতরে, অন্য দুটি বনানী ডিওএইচএস এলাকা ও লেকশোর হোটেলের নিচে। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ অফিসে কাজ করতেন। এরা তারিক সিদ্দিক ও শেখ হাসিনার প্রতি খুবই অনুগত ছিলেন। একেবারে ডিএনএ টেস্টেড। কাগজে-কলমে এ অফিসের কোনো রেকর্ড রাখা হয়নি। এ অফিসে যারা কাজ করতেন তাদের বেতন-ভাতা সরকার থেকে দেওয়া হতো না। এনএসআইয়ের সোর্স মানি থেকে এ বেতন-ভাতা দেওয়া হতো। গাড়ি এবং অফিস ভাড়াও ছিল সোর্স মানির টাকায়। এই উইং এনএসআইয়ের অর্গানোগ্রামে নেই এবং এর কোনো সরকারি অনুমোদনও ছিল না। এনএসআইয়ের রেকর্ডের অস্তিত্ব রাখা হয়নি। এ উইংয়ের কাজ ছিল ‘র’-এর কচুক্ষেতের উইং থেকে আসা নির্দেশাবলি পালন এবং ওই অফিসকে ফিডব্যাক দেওয়া। কর্নেল মোস্তফা নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এ উইংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনা ও তারিক সিদ্দিকের খুবই বিশ্বস্ত একজন কর্মকর্তা বলে জানা গেছে।

তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশের সংশ্লিষ্ট হওয়া

সেনা অফিসারদের পাশাপাশি র‌্যাব ও পুলিশের দেশদ্রোহী কিছু কর্মকর্তাও তারিক সিদ্দিকের অপকর্মে যোগ দেন। এদের মধ্যে ছিলেনÑতৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ, র‌্যাবের তৎকালীন ডিজি মোখলেছুর রহমান, তৎকালীন আইজিপি শহিদুল ইসলামসহ অন্যরা। এরা তারিক সিদ্দিকের মুরিং হাউস ও পরে ২০৮ নম্বর বাড়িতে যাতায়াত করতেন, মিটিং করতেন এবং নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতেন। তারিক সিদ্দিকের মিশনে র‌্যাব-পুলিশ যুক্ত হওয়ায় গুম ও আয়নাঘর শুধু ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ সেনা ও পুলিশ-র‌্যাব কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কে কত গুম করবে এবং আয়নাঘরে নিয়ে মানুষকে বন্দি করবে। গুলশান লেকশোর হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরেও অফিস গড়ে তোলা হয় অপকর্ম বাস্তবায়নের জন্য।

ডিফেন্স পারচেজ ও তারিক সিদ্দিক

মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক তার পছন্দের লোককে সব সময় ডিজিডিপি হিসেবে পোস্টিং দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তারিক সিদ্দিকের ব্লেচিং ছাড়া কেউ এ পদে যেতে পারতেন না। এমনই এক সেনা কর্মকর্তা হলেন মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার। তার মাধ্যমে হাতিরঝিল প্রকল্প ও পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে মোটা অংকের টাকা কমিশন পেয়েছেন তারিক সিদ্দিক। ডিজিডিপি হিসেবে দায়িত্ব শেষে মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান অবসরে যাওয়ার পর তারিক সিদ্দিক তাকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তার মাধ্যমে পূর্বাচল, রূপগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বহু জায়গা-জমির মালিক হন তারিক সিদ্দিক। তার ও স্ত্রী-কন্যাদের নামে ৪৫টি প্লট, ফ্ল্যাট ও শত বিঘা জমি রয়েছে বলে জানা গেছে।

‘প্রচ্ছায়া’ নামে একটি কোম্পানি আছে তারিক সিদ্দিকের। দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রচ্ছায়ার মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল, রূপগঞ্জ এবং গাজীপুর এলাকায় বহু জমির মালিক হন তিনি। স্ত্রী শাহীন সিদ্দিক ও মেয়ে বুশরা ও নুরিন সিদ্দিক প্রচ্ছায়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ২০১৬ সালে দখল করা বেশকিছু প্লট তিনি বিক্রি করে দেন। তবে মালিক হলেও কৌশলগত কারণে প্রচ্ছায়ার কোথাও তার নাম রাখেননি।

সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) ছিদ্দিকুর রহমান সরকার ২০২৪ সালের এপ্রিলে রাজউকে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন দুই বছরের চুক্তিতে। রাজউকের এই চেয়ারম্যান নিজে দুর্নীতি করেন এবং তারিক সিদ্দিককেও কমিশন এবং জায়গা-জমির ব্যবস্থা করে দেন। সম্প্রতি তাকে রাজউক চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। দুদক তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছে। ইতোমধ্যে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

তারিক সিদ্দিকের দুর্নীতির সহযোগী আরেক কর্মকর্তা হলেন মেজর জেনারেল (অব.) আবু সাঈদ মাসুদ। তাকেও তারিক সিদ্দিক ইঞ্জিনিয়ারিং চিফ (ইএনসি) করেন। তিনি হাতিরঝিল ও পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্ণধার ছিলেন। এ দুটি প্রকল্প থেকেও বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন তারিক সিদ্দিক ও আবু সাঈদ মাসুদ।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সালেহ নির্বাচন কমিশনের এনআইডি প্রকল্পের প্রধান ছিলেন। মেজর পদে থাকা অবস্থায়ই তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পর্যন্ত পদোন্নতির ক্ষেত্রে তারিক সিদ্দিকই তাকে সহায়তা করেন। এনআইডি প্রকল্পের স্ক্যান্ডালে জড়িত এ কর্মকর্তাকেও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকের স্ত্রী শাহীন সিদ্দিকও দুর্নীতিপরায়ণ ছিলেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের বড় বড় বদলি ও পদোন্নতি ছাড়াও ব্যবসা পাইয়ে দিয়ে বড় অংকের ঘুষ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসা

মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক বিমানবন্দরের যাবতীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন তার বিশ্বস্ত ও দুর্নীতিপরায়ণ তিন কর্মকর্তার মাধ্যমে। এরা হলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) এসএম নাজমুল আনাম, গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) জিয়াউল আহসান এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন আলমগীর। গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনাম বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশনের সাবেক পরিচালক। তার আরেকটি পরিচয় হলো তিনি ঢাকা উত্তরের তৎকালীন মেয়র আতিকের বোনের স্বামী। বর্তমানে তিনি ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (ICAO) ব্যাংকক অফিসে কর্মরত। বিজিবির সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলামকে বিদেশে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে সহযোগিতার জন্য ব্যাংকক থেকে ছুটে আসেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনাম। মইনুল ইসলামকে বিমানবন্দর দিয়ে পার করে দেওয়ার লক্ষ্যেই তিনি আসেন। কিন্তু মইনুল বিমানবন্দরে ধরা পড়েন। স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যদের যেতে দেওয়া হলেও মইনুল ইসলামকে আটকে দেওয়া হয়। যদিও তার ইমিগ্রেশন হয়ে গিয়েছিল।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) জিয়াউল আহসান ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সাত বছর শেখ হাসিনার এডিসি ছিলেন। এরপর গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনামের জায়গায় তাকে বসানো হয়। এক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়মনীতি ভঙ্গ করা হয়। এডিসিও ডেপুটেশন পোস্ট। নিয়ম হলো ডেপুটেশন থেকে প্যারেন্ট অর্গানাইজেশনে ব্যাক করে আবার ডেপুটেশনে যাওয়া যায়। কিন্তু জিয়াউল আহসানের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। এডিসি থেকে বিমানবন্দরে ডেপুটেশনে পোস্টিং করা হয়। অর্থাৎ ‘ডেপুটেশন টু ডেপুটেশন’। এর মধ্যে সবগুলো প্রমোশনও পেয়ে যান তিনি।

তিনি স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে এডিসি ছিলেন। উইং কমান্ডার হয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশনে যান। একই জায়গায় গ্রুপ ক্যাপ্টেন হন। শমী কায়সারের বয়ফ্রেন্ড ছিলেন বলে জানা যায়। এয়ারপোর্টের অনেক ব্যবসা শমী কায়সারের কোম্পানিকে ইজারা দেন জিয়া। এখনো তা রয়ে গেছে।

তেমনি তারিক সিদ্দিকের আরেক বিশ্বস্ত কর্মকর্তা গ্রুপ ক্যাপ্টেন আলমগীরকে দিয়ে অ্যাভিয়েশন খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন আলমগীর বিমানবন্দরে নিয়োজিত আভালন (AVALON) কোম্পানি তারিক সিদ্দিকের হয়ে দখল করে নেন। প্রতিষ্ঠানটি ছিল গাজীপুরের সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা অধ্যাপক এমএ মান্নানের ছেলে ব্যারিস্টার মঞ্জুরুল করিম রনির। আভালন বিমানবন্দরে বিভিন্ন দেশের পরিবহন ও যাত্রীবাহী বিমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন ও ফুয়েল চেক করা, বিমানের ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, ওয়াশ রুম পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি।

দুদদের অনুসন্ধান, বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা ও মাল্টার নাগরিকত্ব প্রসঙ্গ

মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিক গত বছরের ৫ আগস্ট পরিবারসহ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। বর্তমানে তারা লন্ডনে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তারিক সিদ্দিকসহ তার পরিবারের সদস্যরা মাল্টার নাগরিকত্ব চেয়ে পাননি। দুর্নীতি, অর্থপাচার, প্রতারণা ও ঘুস গ্রহণের অভিযোগ থাকায় তাদের দেশটি নাগরিকত্ব দেয়নি। তারিক সিদ্দিক তার মেয়ে বুশরা সিদ্দিককে লন্ডনে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। ওই ফ্ল্যাটেই বর্তমানে তারা অবস্থান করছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তারিক সিদ্দিক, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। তাদের নামে একাধিক মামলাও হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা পালিয়ে গেলেও আদালত তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাদের ১৩টি ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে।