Image description
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে ছাপানো পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এনসিটিবির দরপত্রে বইয়ের উজ্জ্বলতার জন্য নির্দিষ্ট মান থাকলেও অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সেটি অনুসরণ করেনি। এসব বই বাঁধাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের গাম। পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠা সংখ্যার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে নয়ছয়। এমন অনিয়ম, অসঙ্গতিতে ভরা অন্তত ৩৩ শতাংশ নিম্নমানের বই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ১৩ কোটি বইয়ের মানই খারাপ। এসব বই ছাপিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা বিলের নামে তুলে নেওয়া হয়েছে। আবার অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান যথাসময়ে বই সরবরাহ করেনি। এতে শিক্ষার্থীরা বেশ ভালোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সূত্র জানায়, কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান, এনসিটিবি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বই নিয়ে এমন অনিয়ম করা হয়েছে। ৩০টির বেশি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এবার খারাপ বই ছাপানোর কারণে ১৬টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছি। তারা দরপত্রের মান ঠিক রেখে আবার শিক্ষার্থীদের বই রিপ্লেস করবে। যদি সেটি সম্ভব না হয়, তাদের অর্থদণ্ড করা হবে। এরপরও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটিবি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত ছিল। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে বিনামূল্যে বই ছাপাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে।

যেভাবে প্রকাশ পেল নিম্নমানের বইয়ের তথ্য : এনসিটিবি বিভিন্ন পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে ৩২টি টিম ৬৪ জেলায় মাঠপর্যায়ে পাঠানো হয়। টিমগুলো প্রতিটি জেলার একটি উপজেলা থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে বই সংগ্রহ করে। এরই মধ্যে ৪৭টি জেলার বই সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মধ্যে ৩৩ শতাংশ বই নিম্নমানের হিসাবে দেখতে পেয়েছেন টিমের সদস্যরা। প্রাপ্ত হিসাবে ৪০ কোটি বইয়ের মধ্যে ১৩ কোটি বই নিম্নমানের।

এছাড়া বইয়ের মান যাচাই করতে হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইনস্পেকশন সার্ভিস নামে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপার পরের মান যাচাইয়ের জন্য নিয়োগ দেয় এনসিটিবি। ওই প্রতিষ্ঠানটিও মাঠপর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করেছে। তাদের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে দৈবভাবে সংগ্রহ করা ৩ লাখ ১৯ হাজার নিম্নমানের বইয়ের মধ্যে ২০ শতাংশ বই নিম্নমানের। অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ইবতেদায়ি ৩য় শ্রেণির বিজ্ঞান বইটি নিম্নমানের। দরপত্রের নির্ধারিত মান অনুযায়ী কাগজের মান ৮০ জিএসএমের পরিবর্তে এতে ৭৩ জিএসএম ব্যবহার করা হয়েছে। রেদওয়ানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ভোকেশনাল ৯ম শ্রেণির জেনারেল মেকানিক্স বইয়ে ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে ৬৫ জিএসএম কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও জানা যায়, অনুপম প্রিন্টার্স মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির রসায়ন বইয়ে ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে মাত্র ৬১ জিএসএম কাগজ, শাফিন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন মাধ্যমিক ভোকেশনাল ৭ম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের মান ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে অতি নিম্নমানের ৫৯ জিএসএম কাগজ, সুবর্ণা প্রিন্টার্স মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির গণিত বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএমের পরিবর্তে ৫৫ জিএসএম কাগজ, এ্যারিস্টোক্র্যাটস সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং দাখিল ৬ষ্ঠ শ্রেণির আকাইদ বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে ৫৬ জিএসএস কাগজ, লেটার এন কালার লি. ইবতেদায়ি ১ম, ২য় ও ৪র্থ শ্রেণির বইয়ের নির্ধারিত মান ৮০ জিএসএম পরিবর্তে ৭০ জিএসএম কাগজ, বর্ণমালা প্রেস মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির ব্যবসায় উদ্যোগ বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে ৫৮ জিএসএম কাগজ, ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস দাখিল নবম শ্রেণির গণিত বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে ৬৩ জিএসএম ব্যবহার করা হয়েছে। বর্ণমালা নবম শ্রেণির জীববিজ্ঞান বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে ৬০ জিএসএম কাগজ, দোয়েল প্রিন্টার্স দাখিল ১০ম শ্রেণির উচ্চতর গণিত বইয়ের নির্ধারিত মান ৭০ জিএসএম পরিবর্তে সাড়ে ৬৫ জিএসএম কাগজ, দ্য গুডলাক ইবতেদায়ি ৪র্থ শ্রেণির কুরআন মজিদ ও তাজভিদ শিক্ষা বইয়ের নির্ধারিত মান ৮০ জিএসএম পরিবর্তে ৭১ জিএসএম কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। এসব নিম্নমানের বই ছাপানোর নেপথ্যে উৎপাদন ও বিতরণ শাখার কিছু কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও জানা গেছে।

হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইনস্পেকশন সার্ভিসের ম্যানেজার মোহাম্মদ শাহ জামান বলেন, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক বিতরণের পর দেশের প্রতিটি উপজেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব পরীক্ষা করেছি। আমাদের পর্যালোচনায় প্রায় ২০ শতাংশ বইয়ের গুণগত মান নিম্নমানের পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রে জিএসএম (গ্রাম পার স্কয়ার মিটার) নির্দেশনা মানা হয়নি এমন ২০টি প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগপত্র নমুনা কপিসহ এনসিটিবিতে জমা দিয়েছি।

এদিকে যুগান্তরের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনেও প্রায় একই রকম তথ্য উঠে এসেছে। রাঙামাটির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা বেশিরভাগ বই নিম্নমানের কাগজের। এতে দেখা যায়, কাশেম অ্যান্ড রহমান প্রিন্টিং প্রেসের নবম-দশম শ্রেণির গণিত বইয়ে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে ৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সরেজমিন তথ্য সরবরাহ করা হয়। দেখা যায়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবকটি পাঠ্যবই মুদ্রণে ৮০ গ্রামের কাগজের পরিবর্তে ৬০ গ্রাম (ড্যাম) কাগজে বই ছাপানো হয়েছে। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য আমার বাংলা বই, ইংলিশ ফর টুডে, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, প্রাথমিক গণিত বইগুলো ৬০ গ্রামের (ড্যাম) কাগজে ছাপানো হয়। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান এসএস প্রিন্টার্স বইগুলো ছাপিয়েছে। অন্যদিকে ১ম শ্রেণির আমার বাংলা বই, দ্বিতীয় শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে, গণিত, তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় পাঠ্যবইগুলো শাপলা প্রিন্টার্স এবং পঞ্চম শ্রেণির বইগুলো অগ্রণী প্রিন্টার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠান ছাপিয়েছে। এছাড়া মাধ্যমিকের জন্য যথাক্রমে, চারুপাট, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, বিজ্ঞান, শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, ইংলিশ ফর টুডে, কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা, গণিত, কৃষি শিক্ষা, আনন্দ পাঠ, চারু ও কারুকলা, বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ও ইসলাম শিক্ষাসহ সৃষ্ট ১৪টি পদের বই ছাপিয়েছে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অনন্য প্রিন্টার্স। সব বইতেই নিম্নমানের ৬০ গ্রামের ড্যাম কাগজ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির জন্য ছাপানো বইগুলোতেও ৬০ গ্রামের নিম্নমানের ড্যাম কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে।

একাধিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান বইগুলো ছাপিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে-সৃষ্টি প্রিন্টার্স, অগ্রণী প্রিন্টার্স, মাস্টার সিমেক্স পেপার, সরকার প্রেস, সরকার প্রিন্টার্স ও কর্ণফুলী প্রিন্টার্স নামক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান বইগুলো ছাপায়। এতে নিম্নমানের ৬০ গ্রাম কাগজ ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সবক্ষেত্রে তাদের বইয়ের চিত্র একই বলে জানা গেছে।

লক্ষ্মীপুর ফজুমিয়ারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লোকমান হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বইগুলো ৮০ গ্রাম কাগজে ছাপানো না হলেও গত বছরের তুলনায় মান খারাপ নয়।

মাস্টার সিমেক্স পেপারের পরিচালক শেখ ইমরান হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এনসিটিবির দরপত্র অনুযায়ী আমাদের সব বই ছাপানো হয়েছে।

এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) চলতি দায়িত্ব মুহাম্মদ ফাতিহুল কাদীর যুগান্তরকে বলেন, বই ছাপানোর মনিটরিংয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের কর্মকর্তাদের গাফিলতি রয়েছে। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো অপরাধ করতে করতে সবকিছু তাদের হাতের নাগালে। তারা টাকা দিয়ে সব ম্যানেজ করে ফেলে। ইতোমধ্যে আগামী শিক্ষাবর্ষের ৬ষ্ঠ, ৭ম ও প্রাক-প্রাথমিক জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ার কাজ চলছে।