
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নগরীতে ২১টি পশুর হাট বসাতে গত মাসের শেষদিকে ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয়। এর মধ্যে জনবহুল স্থানে হওয়ায় দক্ষিণ সিটির আফতাবনগর ও মেরাদিয়া এবং উত্তর সিটির বাড্ডা ও খিলক্ষেতে হাট বসাতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ কারণে উত্তর সিটি আরও দুটি স্থানে হাট বসাতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এতে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ সিটিতে ৯টি ও উত্তর সিটিতে ১২টি অস্থায়ী পশুর হাট বসতে পারে। এ ছাড়া গাবতলী ও সারুলিয়ায় দুটি স্থায়ী হাটসহ এবার রাজধানীতে পশুর হাট বসতে পারে ২৩টি। গত বছর গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতাকর্মীরা পলাতক থাকায় এবার অধিকাংশ হাটই যাচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীদের হাতে। তবে ঈদের আর ৬ দিন বাকি থাকলেও এখনো অধিকাংশ হাটের ইজারাদার চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে তিনটি অবৈধ হাট বসেছে। আরও তিনটি অবৈধ হাট বসানোর প্রস্তুতি চলছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্র জানায়, ৯টি হাটের মধ্যে ৫টি হাটের ইজারা প্রক্রিয়ার ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে, কেবল কার্যাদেশ দেওয়া বাকি। বাকি চারটির জন্য দুই দফায় দরপত্র আহ্বান করেও ইজারাদার চূড়ান্ত করা যায়নি। সবশেষ তৃতীয় দফার দরপত্র জমার সময়সীমাও গত বৃহস্পতিবার পার হয়েছে। এই চারটি হাট হলো– দনিয়া কলেজের পাশে খালি জায়গা, কমলাপুর সাদেক হোসেন খোকা মাঠের খালি জায়গা ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল হাট, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের খালি জায়গা এবং শ্যামপুর কদমতলী ট্রাক স্ট্যান্ড-সংলগ্ন খালি জায়গা। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভে নগর ভবন তালাবদ্ধ থাকায় ইজারা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কায়জার মোহাম্মদ ফারাবি কালবেলাকে বলেন, ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের দরপত্রে চারটি হাটের মধ্যে দুটির ইজারামূল্য সরকারি মূল্যের চেয়ে বেশি থাকায় যাচাই-বাছাই কমিটিতে তাদেরই পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাকি দুটি হাটে তৃতীয় পর্যায়ে দরপত্র জমার সময় ২১ মে শেষ হয়েছে। নগর ভবনের কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ায় তৃতীয় পর্যায়ের ইজারার নতুন সময়ের দরপত্র আহ্বান করা যাচ্ছে না।’
ডিএসসিসির প্রশাসক শাহজাহান মিয়া চলমান প্রশাসনিক অচলাবস্থার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে আমরা কোনো সেবা দিতে পারছি না। এমনকি আমাদের ফাইলও দেখতে পারছি না। অবরোধের কারণে, আমরা পশুর হাটের ইজারা চূড়ান্ত করতে বা ওয়ার্ক অর্ডার দিতে পারছি না।’
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মে করপোরেশন এলাকার ৮টি পশুর হাটের প্রথম পর্যায়ের উন্মুক্ত ইজারা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে গত শনিবার যাচাই-বাছাই শেষে খিলক্ষেত মস্তুল চেকপোস্ট-সংলগ্ন খালি জায়গায় সুরমি এন্টারপ্রাইজের নামে মজিবুল্লা খন্দকার হাটের ইজারা নিয়েছেন। তবে হাটটি পরিচালনা করছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আকতার হোসাইন। আর ঢাকা পলিটেকনিকের খেলার মাঠের হাটটি ডিএসসিসি প্রথমে সর্বোচ্চ দরদাতাকে বাদ দিয়ে ৭৭ লাখ টাকা কমে তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা এসএফ করপোরেশনকে ইজারা দিতে কার্যাদেশ প্রস্তুত করলেও সমালোচনা মধ্যে হাটটির ইজারা পুনঃবিবেচনা করছে। হাটটি এখন সর্বোচ্চ ২ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জায়ান এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী যুবদল নেতা মনিরুজ্জামান পাচ্ছেন বলে ডিএনসিসি সূত্র জানিয়েছে। বাকি ছয়টি হাট দ্বিতীয় পর্যায়ের ইজারার জন্য পুনঃবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
গত মঙ্গলবার ডিএনসিসির এই ছয়টি হাটসহ মোট সাতটি হাটের ইজারার দর উন্মুক্ত হয়। মিরপুর কালশী বালুর মাঠের খালি জায়গা সংলগ্ন হাটটিতে সরকারি মূল্যের চেয়ে ৫০ লাখ টাকা কমে ৩০ লাখ ২০ হাজার টাকায় সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘হাটের জায়গাটি অত্যন্ত কম। এর ফলে সরকারি মূল্যের চেয়ে কম হলেও সর্বোচ্চ দর আমি দিয়েছি। করপোরেশনের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। হাটটি পেতে আমি আশাবাদী।’
ভাটুলিয়া সাহেব আলী মাদ্রাসা হতে ১০ নম্বর সেক্টর রানাভোলা অ্যাভিনিউ সংলগ্ন উত্তরা রানাভোলা সুইচগেট পর্যন্ত হাটটির সর্বোচ্চ ৯৫ লাখ টাকা দর দিয়েছেন মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আতিকুর রহমান। মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং হাটটি প্রথম পর্যায়ের ইজারায় বিএনপি ও জামায়াতের দুই নেতা ২ কোটি টাকা সমমূল্য দেওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ইজারা অনুষ্ঠিত হয়। হাটটি এবার সর্বোচ্চ দরে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় পেয়েছেন মেসার্স সোহাগ এন্টারপ্রাইজের রতন মিয়া। এই হাট এলাকায় মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম বসবাস করেন। রতন মিয়া জানান, তিনি ব্যবসায়ী, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তবে হাটের সঙ্গে মহানগর বিএনপি নেতাকর্মীরা যুক্ত আছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
মোহাম্মদপুর বছিলার পশুর হাটটিতে সর্বোচ্চ ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা দর দিয়েছেন মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জালাল মৃধা। ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁচকুড়া বাজার সংলগ্ন রহমান নগর আবাসিক এলাকার হাটের ইজারায় সর্বোচ্চ ১৩ লাখ টাকায় আরহাম এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী বিএনপি নেতা শাহ মিরাজ দর দিয়েছেন। ভাটারা সুতিভোলা খাল সংলগ্ন হাটটিতে তামিম এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারী বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম সরকারি মূল্যের চেয়ে ৭০ লাখ টাকা কমে সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকা দর দিয়েছেন।
এদিকে উত্তরা দিয়াবাড়ি হাটটির ইজারা দর উন্মুক্তের সময় বিএনপির দুই গ্রুপ করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সামনেই বিবাদে জড়ায়। হাটটির সরকারি দর ৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এই হাটে পাঁচজন দরদাতার মধ্যে একজন চায়না বাংলা ট্রেডিংয়ের সত্বাধিকারী মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শিমুল আহমেদ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা দর দেন। তিনি ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার পে-অর্ডারও জমা দেন। তবে সর্বোচ্চ দরদাতা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এক খোকনের কর্মী এস এম ব্রাদার্সের সত্বাধিকারী আসলাম হোসেন ১০ কোটি টাকা দর দিলেও তিনি দরের সঙ্গে পে-অর্ডারের মূলকপি না দিয়ে শুধু ফটোকপি জমা দেন। এই সময় শিমুল আহমেদের কর্মীরা আসলামের দরপত্রটি বাতিল করতে বলেন। আর খোকনের কর্মীরা সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে তাদের ইজারা দেওয়ার দাবি জানায় করপোরেশনের কাছে। খোকন বলেন, ‘হাটের সঙ্গে খোকন ভাই আছেন। আমরা সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে হাটটি পাব বলে আশা করছি।’
ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, বুধবার মিরপুর গাবতলী স্থায়ী হাট ও খিলক্ষেত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচের খালি জায়গার হাটটির ইজারার দর উন্মুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া মেরুলবাড্ডা কাঁচাবাজার ও বালুর মাঠের পাশে পূ্র্ব হাজীপাড়ার খালি জায়গার এলাকাবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরও দুটি হাট বসানোর প্রস্তুতি নিয়েছে ডিএনসিসি।
অবৈধ হাট বসছে: ডিএসসিসির ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে কামরাঙ্গীরচরে চলতি বছর কোনো গরুর হাটের ইজারা দেয়নি সিটি করপোরেশন। তবে এই জায়গায় যুবদল নেতা সোহেল আরমান ও বিএনপি নেতা মনির চেয়ারম্যান মিলে অবৈধ গরুর হাট বসিয়েছেন। কলাবাগান কলোনির মাঠে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা আরেকটি হাট বসিয়েছেন। হাতিরঝিল ঘেঁষে বাংলামটরে আরেকটি হাট বসছে। শ্যামপুরে শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতির স্বল্পতা দেখিয়ে হাটের ইজারা নিতে অপরাগতা প্রকাশ করলেও সেখানে অবৈধ হাট বসানো হচ্ছে। বনশ্রী আর মেরাদিয়া এলাকায়ও চলছে অবৈধ হাটের প্রস্তুতি।
ডিএনসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা ফারজানা খানম বলেন, ‘মস্তুল হাটটির ইজারাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে কাগজপত্র আর পে-অর্ডারের ঝামেলা না থাকলে দু-এক দিনের মধ্যে এসব হাটের কার্যাদেশ দেওয়া হবে। আরও দুটি নতুন হাট বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে করপোরেশন। অবৈধ হাট উচ্ছেদে করপোরেশন কঠোর। ইজারা ছাড়া কোথায় হাট বসতে দেয়া হবে না।’
ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা হাসিবা খান বলেন, ‘অবৈধভাবে পশুর হাট বসানোর সুযোগ নেই। কিছু এলাকায় অবৈধ হাট বসানোর অভিযোগ পেয়ে এরই মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। প্রত্যেক আঞ্চলিক কর্মকর্তাকে তাদের এলাকায় অবৈধ হাট যাতে না বসে, এজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।’
এদিকে গাবতলীর স্থায়ী পশুর হাটের ইজারা নিয়েও চলছে নানা জটিলতা। গত ৩ মার্চ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর সর্বোচ্চ সোয়া ২২ কোটি টাকা দর দিয়েছিল মেসার্স আরাত মোটরস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এটি নির্ধারিত দরের চেয়ে ৭ কোটি টাকা বেশি। সঙ্গে আরও ২৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর ও আয়কর রাজস্ব খাতে যুক্ত হতো। কিন্তু সর্বোচ্চ দরদাতাকে হাটের ইজারা না দিয়ে ডিএনসিসি হাটটিতে খাস আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এ ঘটনায় সম্প্রতি দুদক ডিএনসিসিতে অভিযান চালিয়ে কাগজপত্র জব্দ করে। পরে গাবতলী হাটের ইজারা বিজ্ঞপ্তি দেয় করপোরেশন।
গত বুধবার গাবতলী হাট ইজারার জন্য সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকা দর দিয়েছে টিএইচ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ট্রেড লাইসেন্স অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির মালিক আলী হায়দার নামে এক ব্যক্তি। দর ঘোষণার পরই সেখানে উপস্থিত থাকা অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরা হট্টগোল শুরু করেন। ইজারাপ্রত্যাশী অন্য দরদাতাদের প্রতিনিধিরাও টিএইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক আলী হায়দারকে চিনতে পারছেন না। তার রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না, তা মিরপুরের স্থানীয় বিএনপি নেতারা জানাতে পারেননি।
এদিকে, ইজারা কার্যক্রম শেষ না হলেও সম্ভাব্য ইজারাদাররা হাট বসানোর প্রস্তুতি শেষ করেছেন। গ্রামগঞ্জের খামারিদের হাটে গরু নিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগও শেষ করেছেন। আশা রাখছেন, আগামী দুদিনের মধ্যে অধিকাংশ পশু হাটে এসে পৌঁছাবে। আর আগামীকাল রোববার থেকেই শুরু হবে বেচাকেনা।