Image description

হুট করে বৃষ্টি নামল। একটা টং দোকানে ঢুকে পড়লাম। চায়ে চুমুক দিচ্ছি, কানে এলো দুজনের কথা। ৫০ টাকার একটা নোট দেখিয়ে এক তরুণ বললেন, বাংলাদেশে আর কোনো নোটে এমন চিত্রকর্ম নেই।

নোটটা কী সুন্দর না? এটি জয়নুলের চিত্রকর্ম।

সায় দিয়ে পাশের জন বললেন, বাজারে নাকি নতুন নোট আসবে। আজও জানলাম না আমাদের নোটগুলোর ডিজাইনার কে!

এমন সময় পাশে বসা এক ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন, এই নোটটার নকশা আমার করা।

ভদ্রলোক মাঝবয়সী। গায়ে হাফশার্ট। মাথায় টুপি। মুখে সাদা দাড়ি। চোখে চশমা।

শুনে অবাক দুই তরুণ। বেশ কৌতূহল হলো। পরিচয় দিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ জমালাম। সদালাপী মানুষটির নাম মুছলিম মিয়া। থাকেন গাজীপুরে। কথায় কথায় জানলাম, শুধু ৫০ টাকার নোটই নয়, দেশে এখন প্রচলিত সব নোটেরই নকশাকার তিনি। আগামীকাল বাজারে যে নোটগুলো আসছে, সেগুলোও তাঁর নকশায় করা। নতুন নোটগুলোর নকশা প্রণয়ন কমিটির সদস্য তিনি।

ইচ্ছামতো আঁকতেন : কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর ধুলদিয়া গ্রামের সন্তান মুছলিম মিয়া। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি মেজো। শৈশবে ইচ্ছামতো আঁকতেন। খাতাপত্র তো বটেই, বাড়ির দেয়াল, আশপাশের ভবনসবই তাঁর ক্যানভাস। আঁকার উপাদান বলতে কয়লা, ইটের গুঁড়া আর সবুজ রং। দেখে প্রশংসা করত অন্যরা।

তাঁর বড় ভাই পড়তেন মোহাম্মদপুরের গ্রাফিকআর্ট কলেজে। এসএসসি পাসের পর তিনি মুছলিম মিয়াকে বললেন, এখানে একটা আর্ট কলেজ আছে। ভর্তি হবি? পরে দুই ভাই মিলে গেলেন আর্ট কলেজে (এখনকার চারুকলা অনুষদ)। সেখানেই দেখা শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের সঙ্গে। তিনি একটা মাটির পট এবং কয়েকটা পাতার চিত্র দিয়ে বললেন, এগুলো আঁকার চর্চা করো। দিন কুড়ি পর উনাকে আবার দেখালেন। পরে লিখিত ও অঙ্কন পরীক্ষার বৈতরণী পার হয়ে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হলেন মুছলিম মিয়া। ১৯৭৮ সালে প্রি-ডিগ্রিতে ভর্তি হলেন চারুকলায়। ছাপচিত্র বিভাগ থেকে স্নাতক হলেন ১৯৮৪ সালে।

এক নামে চিনত তাঁকে : তখন তিনি প্রথম বর্ষে। জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। কাঠের ওপর করা মুছলিম মিয়ার একটা শিল্পকর্ম ঠাঁই পেল প্রদর্শনীতে। এর পর থেকে এশিয়ান আর্ট বিয়েনালেসহ ঢাকায় আয়োজিত প্রদর্শনীগুলোতে থাকত মুছলিম মিয়ার ছবি। সেই সুবাদে চারুকলায় সবাই এক নামে চিনত তাঁকে।

স্নাতকের পর একটা অ্যাড ফার্মে যোগ দিলেও ফরমায়েশি কাজে মন বসছিল না। এনগ্রেভার পদে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে তিনি আবেদন করেন। ভাইভা বোর্ডে এক পরীক্ষক কাগজ, পেনসিল ও রাবার দিয়ে বললেন, ১০ মিনিট সময়। আমার একটা পোর্ট্রেট আঁকেন। মুছলিম মিয়ার আঁকা দেখে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ। পরে জেনেছেন সেই ভদ্রলোক ছিলেন টাঁকশালের প্রধান প্রকৌশলী।

অনেক দূর যাবে : ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে শিক্ষানবিশ এনগ্রেভার পদে যোগ দিলেন। তখন গাজীপুরে টাঁকশাল ভবন নির্মাণ হচ্ছিল। সিনিয়ররা যেসব নকশা করতেন, সেগুলো নিজের মতো করে আঁকতেন। ১৯৮৬ সালে দুই টাকার নতুন নোট ছাড়ার উদ্যোগ নিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নকশা করেন শিল্পী রফিউদ্দিন। ট্রেসিং পেপারে দোয়েল পাখির স্কেচটা করে দিলেন মুছলিম মিয়া।

১৯৮৭ সালে প্রশিক্ষণের জন্য শিল্পী মাহমুদা খাতুন আর মুছলিম মিয়াকে পাঠানো হলো সুইজারল্যান্ড। সেখানে টাকা, মুদ্রা নকশা ও অবয়ব খোদাই (এনগ্রেভিং) বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিলেন। ইতালিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের একজন এনগ্রেভার ছিলেন তাঁদের প্রশিক্ষক। মুছলিম মিয়ার আঁকা দেখে সেই প্রশিক্ষক বলেছিলেন, তোমার কাজের যে গতি, লেগে থাকলে অনেক দূর যেতে পারবে।

উৎপাদনে গেল টাঁকশাল : ১৯৮৮ সালে দেশে ফিরলেন মুছলিম মিয়া। তত দিনে টাঁকশাল ভবন নির্মাণ হয়ে গেছে। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, এস এম সুলতানসহ ব্যাংক নোটে ব্যবহার উপযোগী অনেকে পোর্ট্রেট করতে লাগলেন। ১৯৮৯ সালে উৎপাদনে গেল টাঁকশাল। দেশেই শুরু হলো টাকা ছাপানো। প্রথমে এক ও ১০ টাকার নোট ছেপেছিল। তখনো দেশে লেটার এনগ্রেভিং মেশিন ছিল না। তাই বিদেশ থেকে করিয়ে আনা হয়েছিল।

প্রথমে এখানে ছাপানো এক টাকার নোটের নকশা করাই ছিল। নোটটি বাজারে ছাড়া হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। নকশাকার ফজলুল করিম। চাকরি করতেন পাকিস্তান সিকিউরিটি প্রিন্টিংয়ে। গাজীপুরে আর যোগ দেননি। টাঁকশাল চালুর পর মুছলিম মিয়ারা নকশা শুরু করলেন। অনেক ডিজাইন করা হয়েছিল। শিল্পী মাহমুদা খাতুন স্মৃতিসৌধের ছবিযুক্ত ৫০ টাকার নোটের ডিজাইন করলেন। শিল্পী রফিউদ্দিন আহমেদ দোয়েল পাখিওয়ালা দুই টাকার নোটের নকশা করলেন ১৯৮৮ সালে। তাঁরা আরো কিছু নোটের নকশা করেছিলেন। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেগুলো পছন্দ করেনি। তারা নতুনত্ব চাইছিল।

মুছলিম মিয়ার নকশা : ১৯৯৫ সালের দিকে প্লেট খোদাইয়ের কাজ করতেন মুছলিম মিয়া। একদিন টাঁকশাল কর্তৃপক্ষ ডেকে বলল, আমাদের যে দুজন ডিজাইনার আছেন, তাঁরা কিছুদিন পর অবসরে যাবেন। আপনিই নকশা করেন, দেখি কেমন হয়।

১০, ৫০ আর ৫০০ টাকার নোটের ডিজাইন বদলাতে চেয়েছিল কর্তৃপক্ষ। মুছলিম মিয়া পরীক্ষামূলকভাবে নোটগুলোর নকশা করলেন। অন্যরাও করল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক পছন্দ করল মুছলিম মিয়ারটা। প্রথমে তারা পছন্দ করল বঙ্গবন্ধুর ছবিযুক্ত একটি নীল রঙের ১০ টাকার নোট। উল্টো পাশে ছিল লালবাগকেল্লা মসজিদ। একটা ৫০০ টাকার নোটের রং ছিল লালচে হলুদ। সামনে স্মৃতিসৌধ, পেছনে হাইকোর্ট ভবন। ৫০ টাকার নোটের সামনে সংসদ ভবন, পেছনে রাজশাহীর বাঘা মসজিদ। ১৯৯৬ সালে তিনটি নোটই অনুমোদন পেল। নোটগুলো প্রসেসিংয়ের জন্য ১৯৯৭ সালে আবার সুইজারল্যান্ড গেলেন মুছলিম মিয়া। কালার সেপারেশন ও প্লেট করে সেগুলো দেশে এনে ছাপানো হলো। এরপর দুই টাকা, ২০ টাকার নোটও মডিফাই করলেন। মানে নোটগুলো বেশ বড় ছিল। পরে সেগুলো স্ট্যান্ডার্ড সাইজ করা হয়েছে। আবার ১০০ ও ৫০০ টাকার নতুন নোটও ডিজাইন করলেন। হাঙ্গেরিতে গিয়ে সেগুলো প্রসেস করলেন মুছলিম মিয়া। বাংলাদেশের প্রথম ১০০০ টাকার লাল রঙের নোটটাও (শহীদ মিনারের ছবিযুক্ত) তাঁর নকশায় করা।

কয়েক কোটি টাকা সাশ্রয় হলো : ২০০০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো পলিমারে করা ১০ টাকার নোট চালু হলো। নকশাকার এক অস্ট্রেলিয়ান। কিন্তু আমাদের টাঁকশালে এ ধরনের নোটের কাজ করার মতো উপযুক্ত কম্পিউটার ছিল না। মুছলিম মিয়া নিজের বাসার কম্পিউটার সেট নিয়ে গিয়েছিলেন টাঁকশালে। সেখানেই নোটটার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন সেই ডিজাইনার। সেই সুবাদে মুছলিম মিয়াও শিখলেন পলিমারে নকশার কলাকৌশল। নতুন সরকার এসে নোটটা আবার কাগজে ছাপতে চাইল। পরে বঙ্গবন্ধুর ছবির জায়গায় সরকারি মনোগ্রাম এবং বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ছবি দিয়ে ১০ টাকার নোটের নতুন ডিজাইন করলেন। এ ধরনের নোটের প্লেট এবং প্রসেসের জন্য যেতে হতো সুইজারল্যান্ড বা হাঙ্গেরিতে। কিন্তু টাঁকশালে বসেই মুছলিম মিয়া প্লেট করলেন, প্রসেসও। এতে সরকারের কয়েক কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছিল।

২০১১ সালে দুই টাকা থেকে শুরু ১০০০ হাজার টাকার নতুন ৯টি নোটের ডিজাইন করলেন।

জয়নুল এলেন নোটে : ১৯৯৬-৯৭ সালের নোটের নকশা বাছাই কমিটিতে শিল্পী রফিকুন নবী, মুস্তাফা মনোয়ার ও কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন। তাঁরা মত দিয়েছিলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি চিত্রকর্ম টাকায় ব্যবহার করলে ভালো হয়। কিন্তু কাজটি আলোর মুখ দেখেনি। পরে যখন নোটের সিরিজ নকশা শুরু করেন মুছলিম মিয়া, তখন আবার শিল্পাচার্যের প্রসঙ্গ এলো। তখন মই দেওয়া চিত্রকর্মটি নির্বাচন করা হয়। কর্তৃপক্ষ বলেছিল, চিত্রকর্মটি যেন হুবহু থাকে। হাঙ্গেরিতে এই নোটের কালার সেপারেশন করা হয়েছিল। লাইন ডিরেকশনও দেখিয়ে দিয়েছিলেন মুছলিম মিয়া।

যেভাবে হয় নোটের নকশা : নোটের নকশা বদলের দরকার হলে বাংলাদেশ ব্যাংক টাঁকশাল কর্তৃপক্ষকে এ ধারণা দেয়। সে অনুযায়ী কিছু খসড়া করেন ডিজাইনাররা। বাংলাদেশ ব্যাংক মনোনীত নকশা প্রণয়ন কমিটি আছে। চারুকলার শিক্ষক, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় এই কমিটি। তাঁরাই নকশার চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। পরে টাঁকশাল কর্তৃপক্ষ সেটা মুদ্রণপ্রক্রিয়া শুরু করে। এ জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহবান করা হয়। ডিজাইনাররা সংশ্লিষ্ট দেশে গিয়ে নোটের নকশা তত্ত্বাবধান করেন। প্রয়োজনীয় প্লেট প্রিন্ট করে ডিজাইনারকে একটা কালার চার্ট দিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। টাঁকশালে আরো কিছু প্রক্রিয়া শেষে কালার ম্যাচিং করে লিথোগ্রাফ ও ইন্টাগ্লিও পদ্ধতিতে ছাপা হয় নোটগুলো, যা হাতে খসখসে অনুভূত হয়।

মুছলিম মিয়া জানালেন, জলছাপ এবং সিকিউরিটি থ্রেডযুক্ত শতভাগ কটন কাগজে বাংলাদেশি নোটগুলো করা হয়। বাছাই কমিটির অনুমোদনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদামতো টাঁকশালে নতুন টাকা ছাপা হয়।   

টাঁকশালের জেনারেল ম্যানেজারের (প্রডাকশন অ্যান্ড কন্ট্রোল, ডিজাইন অ্যান্ড এনগ্রেভিং) পদ থেকে মুছলিম মিয়া অবসর নিয়েছেন ২০২০ সালে। এখন নিজের স্টুডিওতে আঁকাআঁকিতেই সময় কাটছে প্রচারের আড়ালে থাকা মানুষটির।