
রাজস্ব আদায় বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার গতানুগতিকভাবে করহার বাড়ানোর পথে হাঁটতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। সুরক্ষা কমায় শিল্প ঝুঁকিতে পড়তে পারে। পাশাপাশি ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে। ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ও করহার বাড়ানো হবে। এতে সব শ্রেণির করদাতার ওপর করের বোঝা বাড়বে।
আসছে বাজেটে দেশীয় টেক্সটাইল মিলে সুতা উৎপাদনে ভ্যাটহার বাড়ানো হচ্ছে। এতে চাপে পড়বে গ্যাস সংকটে ধুঁকতে থাকা টেক্সটাইল মিলগুলো। প্রতি কেজি কটন সুতা ও ম্যান মেইড ফাইবার সুতার সুনির্দিষ্ট কর (ভ্যাট) ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে ভারতীয় সুতার সঙ্গে প্রতিযোগী সক্ষমতায় আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন মিলমালিকরা।
অন্যদিকে শিল্পের লাভ-লোকসান যাই হোক-বাজেটে দ্বিগুণ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে। অবশ্য টার্নওভারের সীমা এক কোটি বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হচ্ছে। এ পদক্ষেপের ফলে শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসা পরিচালনার জন্য রাজধানীর প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে স্থাপনা ভাড়া নিতে হয়। এ ভাড়ার উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। সাধারণত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেই এই খরচ বহন করতে হয়। ব্যবসার প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করতে কনভেনশন হল, কনফারেন্স সেন্টার ভাড়া নিতে হয়। এ ধরনের হল ভাড়ার উৎসে কর দ্বিগুণ করে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। স্থাপনা ভাড়া বা কনফারেন্স সেন্টার ভাড়ার ওপর উৎসে কর বাড়ানোয় ব্যবসার খরচ বাড়বে।
এছাড়া শিল্পের কর অবকাশ সুবিধাও বাতিল করা হচ্ছে। বর্তমানে ৩১টি শিল্প খাত ১০ বছরের জন্য অঞ্চলভেদে ক্রমহ্রাসমান হারে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে। শিল্প খাতগুলো হচ্ছে-অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রিডিয়েন্ট; কৃষি যন্ত্রপাতি; ব্যারিয়ার কন্ট্রাসেপটিভ ও রাবার ল্যাটেক্স; ইলেকট্রনিক্সের মৌলিক উপাদান (রেজিস্টর, ক্যাপাসিটর, ট্রানজিটর, ইন্ট্রিগ্রেটেড সার্কিট ও মাল্টিলেয়ার পিভিসি); বাই-সাইকেল ও এর যন্ত্রাংশ; বায়ো ফার্টিলাইজার; বায়োটেকনোলজিভিত্তিক কৃষিপণ্য; বয়লারের খুচরা যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জাম; কম্পিউটার হার্ডওয়্যার; আসবাবপত্র; হোম অ্যাপ্লায়েন্স (ব্লেন্ডার, রাইস কুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ইনডাকশন কুকার, ওয়াটার ফিল্টার); কীটনাশক ও বালাইনাশক; চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য; এলইডি টিভি; ফলমূল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াকরণ; মোবাইল ফোন; পেট্রোকেমিক্যাল; ফার্মাসিউটিক্যালস; প্লাস্টিক রিসাইক্লিং; টেক্সটাইল মেশিনারি; টিসু গ্রাফটিং; খেলনা উৎপাদন; টায়ার ম্যানুফেকচারিং; ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সফরমার; ম্যান মেইড ফাইবার উৎপাদন; অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ ম্যানুফেকচারিং; রোবোটিক্স ডিজাইন; এআই-ভিত্তিক সিস্টেম ডিজাইন ও ম্যানুফেকচারিং, ন্যানোটেকনোলজিভিত্তিক পণ্য ম্যানুফেকচারিং এবং এয়ারক্রাফট হেভি মেইনটেন্যান্স সার্ভিস ও খুচরা যন্ত্রাংশ ম্যানুফেকচারিং।
ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক খাতেও করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। অব্যাহতির সংস্কৃতি পরিহার করতে রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, পলিপ্রোপাইন স্টাপল ফাইবারের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এছাড়া মোবাইল ফোন উৎপাদনে হ্রাসকৃত ভ্যাট হার বাড়ানো হচ্ছে। এতে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের সুরক্ষা কমবে, বিদেশি ইলেকট্রনিক্স-সামগ্রী আমদানি বাড়বে। পাশাপাশি ক্রেতার খরচ বাড়বে। গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত সিমেন্ট শিট উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। স্টিল শিল্পের কাঁচামাল ফেরো ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো সিলিকা ম্যাঙ্গানিজ অ্যালয় উৎপাদনে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ভ্যাট আছে, এটি ১ হাজার ২০০ টাকা করা হচ্ছে। ফেরো সিলিকন অ্যালয়ের ভ্যাট দেড় হাজার টাকা করা হচ্ছে।
অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে ভ্যাটহার বাড়ানো হচ্ছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স বা গৃহস্থালিসামগ্রী উৎপাদনে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, ইলেকট্রিক কেতলি, আয়রন, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেসার কুকার উৎপাদনে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৫ শতাংশ, ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে ৭ শতাংশ এবং ২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। লিফটের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে উৎপাদনের জন্য উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে বছরভিত্তিক ভ্যাটহার বাড়ানো হচ্ছে।
এ তো গেল শিল্প ও ব্যবসা খরচ বাড়ার পদক্ষেপ। এবারের বাজেট সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়াবে। হোম অ্যাপ্লায়েন্স, রেফ্রিজারেট ও এয়ার কন্ডিশন শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করায় বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে জনগণের ওপর। অনলাইনে পণ্য বিক্রির দিকেও বাজেটে নজর দেওয়া হয়েছে। বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালিসামগ্রী, হাইজেনিক ও টয়লেটসামগ্রী উৎপাদনে ভ্যাট সাড়ে ৭ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। বর্তমান অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, বাজেটে এটি ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে বিধায় অনলাইনে পণ্য কেনায় ভোক্তাদের বাড়তি অর্থ গুনতে হবে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মও বর্তমানে সাধারণ মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে বিনোদনমূলক টেলিভিশনের চ্যানেলের জায়গা দখল করে নিয়েছে। মোবাইল অপারেটরগুলোর নিজস্ব প্ল্যাটফর্মের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি কিছু ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ঈদসহ নানা উৎসব-পার্বণে নাটক-সিনেমা ও বিদেশি জনপ্রিয় সিরিজ প্রদর্শিত হয়। বাজেটে বিনোদনের এ মাধমেও সম্পূরক শুল্ক বসানো হচ্ছে। এ কারণে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে জনপ্রিয় সিরিজ বা খেলা দেখার খরচ বাড়বে।
আসছে বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। এটি স্বস্তির খবর হলেও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এর সঙ্গে করহারও বাড়ানো হচ্ছে। ভবিষ্যতে ৩ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকর মধ্যে আয় থাকলে করদাতাদের বছরে ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। বাংলাদেশে করদাতাদের মধ্যে এই শ্রেণির করদাতা বেশি। বাজেটে স্ল্যাব পরিবর্তন ও করহার বাড়ানোয় মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা বাড়বে। অন্যদিকে গ্রাম-শহরের করদাতাদের মধ্যে ‘করবৈষম্য’ কমিয়ে আনতে সব করদাতার আয়কর ৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের আয়ের জন্য এ সীমা প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের ওপর নতুন সীমা অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ আয়ের এক-তৃতীয়াংশ কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত। অর্থাৎ তাকে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার ওপর আয়কর দিতে হয়। বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী তার প্রদেয় করের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৮ হাজার টাকা। বাজেটে কর হার ১০ শতাংশ করায় করদাতাকে তখন ১০ হাজার ৫০০ টাকা আয়কর দিতে হবে।
অবশ্য প্রথমবার করদাতাদের জন্য বাজেটে সুসংবাদ আসছে। প্রথমবার রিটার্ন জমা দেবেন-এমন করদাতারা ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা আয়কর দিতে পারবেন। দেশে কর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।