তিন শ সাংবাদিকের ভাগ্য দখল করে রেখেছেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের একজন দোসর রাজধানীর মিরপুরের ইলিয়াস মোল্লা। গণঅভ্যুত্থানের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে এই ‘দখলবাজ গডফাদার’ বলে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য আত্মগোপনে চলে যান, কিন্তু তার কবজা থেকে মুক্তি মেলেনি সাংবাদিকদের ২১ বিঘা জমি।
পল্লবীর আলুন্দি ঝিলপাড়ের ওই জমিতে ইলিয়াস মোল্লার গড়ে তোলা বস্তিতে আগের মতোই চলছে মাদকসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড। নিজে সরকারি দলের সংসদ সদস্য ছিলেন বলে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে সেখানে ঘেঁষতে দেননি ইলিয়াস মোল্লা। কিন্তু এখন এই স্বৈরাচারমুক্ত দেশেও জায়গাটি উদ্ধারে হয়রান হচ্ছেন সাংবাদিকরা।
ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতি সূত্রে জানা যায়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিছুদিন আগে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষকে জায়গাটি দখলমুক্ত করে সাংবাদিকদের বুঝিয়ে দিতে চিঠি দেয়। কিন্তু এখনো জায়গাটি দখলবাজদের কর্তৃত্বেই রয়ে গেছে।
সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ পেয়ে ন্যায্য মূল্যে কেনা জমির নামজারি ও নিয়মিত খাজনা পরিশোধের পরও জায়গাটি বেদখলে থাকায় ক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ।
জানা যায়, ২০০৬ সালে ওই জায়গাটি ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতি লিমিটেডকে বরাদ্দ দেয় সরকার। এ জন্য সমিতি সরকারের কোষাগারে ওই সময়ের সরকারি মূল্যে জমির দাম জমা দেয় ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে। সংগঠনের সদস্য ২৮০ জন সাংবাদিকের কেউ ঋণ করে, কেউবা স্ত্রী-সন্তানের গহনা বা গ্রামের জায়গা বেচে, কেউবা ব্যাংকে সঞ্চিত তার সেভিংস বা এফডিআর ভেঙে নিজের অংশের টাকা পরিশোধ করেন। বরাদ্দ পাওয়ার পর জায়গাটি সীমানা বেড়া দিয়ে মাটি ভরাটের কাজও শুরু করেছিল সমিতি।
পল্লবীর স্থানীয় বাসিন্দা এবং আলুন্দি ঝিলপাড়ের বস্তি এলাকা ঘুরে ও বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইলিয়াস মোল্লা তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সাংবাদিক সমিতির জায়গার চারপাশের লোহা ও টিনের বেড়া লুটপাট করে বেদখল করেন জায়গাটি। এক সময় সমিতির অফিস ঘরও ভেঙে ফেলে তার ক্যাডাররা।
জাতীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের আবাসনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া জায়গাটিতে ইলিয়াস মোল্লা গড়ে তোলেন বস্তি। প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা ভাড়া তোলার পাশাপাশি বস্তিতে অবৈধ মাদকের রমরমা ব্যবসা পরিচালনা করে তার বাহিনী। নানা অসামাজিক কাজ ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ জানা যায় সরেজমিনে
এলাকাবাসী জানায়, ঢাকা-১৬ আসনের এই সাবেক সংসদ সদস্য সাংবাদিকদের জায়গায় তার গড়ে তোলা বস্তি, দোকান ও অস্থায়ী মার্কেটে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার পানির সংযোগ দেন। নিজ দলীয় সরকারের পতনের পর তিনি গা ঢাকা দিলেও এখনো আত্মীয় ও ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে প্রতি মাসে ভাড়া তুলছেন ইলিয়াস মোল্লা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইলিয়াস মোল্লার পাশাপাশি তার ভাগ্নে সালমান মোল্লাও অবৈধভাবে বস্তি ও দোকানঘর তোলেন সাংবাদিকদের ওই জায়গায়। সালমান মোল্লা শুধু বিদ্যুৎ বিল বাবদ বস্তিবাসীর কাছ থেকে প্রতি মাসে চার লাখ টাকা ও বস্তির পূর্ব পাশে অবৈধ স্থাপনা থেকে তিন লাখ টাকা তোলেন। ঝিলের পশ্চিম পাশের বস্তি থেকে ইলিয়াস মোল্লার ছোট ভাই আলী মোল্লা প্রতি মাসে চার লাখ টাকা চাঁদা তোলেন।
সাংবাদিকদের জায়গায় গড়ে তোলা বিশাল বস্তির বিভিন্ন অংশে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ইলিয়াস মোল্লার দলীয় ক্যাডাররা। এ তথ্য জানান বস্তিবাসীদের কয়েকজন। তাদের তথ্যমতে, আলোকদি এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসী সামছু তার সহযোগী সোহেল, ফারুক আনোয়ার গং ওই এলাকায় ইয়াবা, গাঁজাসহ মাদকদ্রব্য বিক্রি করে। এ কাজে স্পট হিসেবে ব্যবহার করা হয় আনোয়ার ও ফারুকের টং দোকান।
বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঝিলপাড় নতুন রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করে সালমান মোল্লার ড্রাইভার ফজলু। মন্দির থেকে মোড় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে আলী মোল্লাহর অফিসের স্টাফ বেলাল ও মাসুদ। জসিম মোল্লার হয়ে বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন তুফান।
ইলিয়াস মোল্লাহর ভাগিনা সালমান মোল্লার হয়ে টাকা তোলেন ড্রাইভার ফজলু। ইলিয়াস মোল্লাহর আপন চাচাতো ভাই জসিম মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান তুফান ।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এখানকার বস্তিতে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে ৫ আগস্ট বিভিন্ন থানা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজত থেকে লুট হওয়া কিছু অস্ত্র থাকতে পারে। মিরপুর এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডে এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
গত ১৬ বছর ধরে ইলিয়াস মোল্লার অবৈধ দখলে থাকা সাংবাদিক সমিতির জমি দখলমুক্ত করতে বহুবার গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছেন বলে জানান ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির সভাপতি সদরুল হাসান।
ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির সভাপতি বলেন, ‘এক পর্যায়ে কিছু অংশ বুঝিয়ে দিলে সেখানে অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করি। কিন্তু কিছুদিন পরই ইলিয়াস মোল্লা লোক পাঠিয়ে ওই স্থাপনা ভেঙে দেন।’
গত ২৮ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে আবেদন করেছেন জানিয়ে সদরুল হাসান বলেন, ‘গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলে পুলিশ সংকটে উচ্ছেদ করতে পারছেন না বলে জানান তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিগত ১৬ বছর ওই এলাকায় ইলিয়াস মোল্লার কথাই ছিল আইন। জমি ছাড়াও বহু দোকান, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড ও ফুটপাত দখল করেন তিনি। এসব নিয়ে কেউ অভিযোগ করলে বাড়ির বৈঠকখানায় সালিশ বসিয়ে আদালতের আদলে বিচার করেন ইলিয়াস মোল্লা। বিচারের রায় পক্ষে দেওয়ার জন্য সহকারীদের মাধ্যমে ঘুষও নিতেন ইলিয়াস মোল্লা- এমন অভিযোগও আছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর পালিয়ে যাওয়ার আগে ইলিয়াস মোল্লা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা করেন তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দমনেও অংশ নেয় তার পাঠানো ক্যাডার বাহিনী।
অভিযোগের বিষয়ে ইলিয়াস মোল্লার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি তিনি পলাতক বলে। মিরপুরে তার বাড়িতে গিয়ে ফটকে তালা ঝুলতে দেখা যায়।