২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সব না হলেও কিছু বই বছরের প্রথম দিনই উঠত শিক্ষার্থীদের হাতে।এবার স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ৪১ কোটি বিনামূল্যের বই ছাপানোর কথা রয়েছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে ৬ কোটি বই। বাকি ৩৫ কোটি সময়মতো যায়নি মূলত তিনটি কারণে৷বিগত কয়েক বছরে পাঠ্যবই ভারতে ছাপা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবার দেশেই বই ছাপানো শুরু হয়। নতুন শিক্ষাবর্ষে বেড়েছে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা। এছাড়া পাঠ্যবইয়ে সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের আমলে প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়’ বলে বাতিলের ঘোষণা দেয়। ফলে বছরের শেষাংশে এসে আগামী বছরের জন্য এক যুগ আগের ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের বই ‘ঘষে-মেজে’ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়।ওই বইগুলোর ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’, ইতিহাসের ‘বিকৃতি’, ‘ব্যক্তি তোষণ’সহ কিছু বিষয় সংশোধন ও পরিমার্জনে অনেকটা সময় চলে যাওয়ায় প্রেসে তা পাঠাতেই অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।
নতুন শিক্ষাবর্ষের বই তৈরির কার্যক্রম শুরু হয় জুন-জুলাই থেকে। এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে তিন মাস দেরিতে শুরু হয় এই কার্যক্রম। বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৫ কোটি বই তুলে দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। বিলম্বের কারণ জানাতে গিয়ে দেশের বাইরে থেকে বই না ছাপানো, শিক্ষাক্রম পরিবর্তনজনিত কারণে বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বই পরিমার্জনের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। বাকি ৩৫ কোটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার সম্ভাব্য তারিখ জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো কমিটমেন্ট দেব না। পাঠ্যবই কবে ছাপা শেষ হবে, তা নিয়ে আমি কিছু বলব না। বই ছাপার প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে কিছু কথা বলব। আমি মনে করি, পাঠ্যবই ছাপার কাজটা এবার শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের মতো হয়েছে।’
প্রতিবছর জুন-জুলাই মাসে বই ছাপার টেন্ডার হয়। গত বছরও একইভাবে টেন্ডার হয়েছিল। নির্দিষ্ট প্রেস কাজও পেয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আগের টেন্ডার বাতিল করা হয়। প্রেসগুলোকে ছাপার কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়। পাশাপাশি বইগুলো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ৪৪১টি বই পরিমার্জন করা হয়েছে। সব কাজ শেষ করে নভেম্বরের শেষে কিছু এবং ডিসেম্বরে কিছু বই ছাপার কাজ দেওয়া হয়। সরকারের কাছ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর বইগুলো ছাপতে কেমন সময় লাগা স্বাভাবিক জানতে চাইলে ব্রাইট প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী এস এম মহসিন ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘অন্তত তিন মাস লাগে। এবার ১৫০টি প্রিন্টিং প্রেসকে ৪১ কোটি বই ছাপার কাজ দেওয়া হয়েছে। আমরা সর্বশেষ অর্ডার পেয়েছি, ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে। এই সময়ের মধ্যে কিভাবে ছাপার কাজ সম্ভব? তারপরও আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রি পর্যন্ত সব বই দিয়েছি।’
এবার বছরের প্রথম দিন কেন শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেওয়া গেল না জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনটিসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘এবার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ৫ আগস্টের পর পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনের প্রয়োজন হলো। ফলে আড়াই মাসে ৪৪১টি পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করা হয়েছে। এরপর টেন্ডার প্রক্রিয়ায় গেছি। টেন্ডারেও তো অনেক সময় লাগে। সবকিছু মিলিয়ে নভেম্বরের শেষে আমরা অর্ডারগুলো দিতে পেরেছি। এ কারণে ঠিক সময়ে বই দিতে পারিনি।’বুধবার রাজধানী ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন ও মোড়ক উন্মোচন’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান বলছেন- ‘১৫ জানুয়ারি’, আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলছেন, ‘৩০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই দেওয়া যাবে।’ আমি কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো কমিটমেন্ট দেব না। পাঠ্যবই কবে ছাপা শেষ হবে, তা নিয়ে আমি কিছু বলব না।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রথম সমস্যাটা হলো, আমরা বিদেশে বই ছাপাব না। তারপর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা হয়েছে অনিবার্য কারণে, তাতে বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। যখন কাজ শুরু করা হয়েছিল, সেটা অনেক দেরিতে হয়েছে। অনেকগুলো বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। রাজনীতিতে নিরপেক্ষ বলে কিছু থাকে না, দলীয় রাজনীতি-নিরপেক্ষ সবকিছু যেন বইয়ে থাকে, সেটা এবার নিশ্চিত করা হয়েছে।’এনটিসিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘প্রিন্টিং প্রেসের মালিকরা অনেক সময় কম দামের কাগজ কেনার জন্যসময় নষ্ট করে ফেলেন। আবার সরকার যেহেতু পহেলা জানুয়ারি বই দেওয়ার ব্যাপারে অনেক বেশি মনোযোগী থাকে, তখন তারা কাগজ পাচ্ছে না বলে ধোঁয়া তুলে কম দামের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোর সুযোগ নেয়। এটা এক ধরনের ব্ল্যাকমেইলিং। আমরা কিন্তু সেই সুযোগ দেইনি। আমরা বলেছি, প্রয়োজনে বই একটু পরে যাবে, কিন্তু কম দামের কাগজে বই ছাপা যাবে না। ফলে যতগুলো বই আমরা দিয়েছি, সবগুলোর কাগজ কিন্তু উন্নত মানের। আগামীতেও বই যাবে উন্নতমানের কাগজে।’
প্রিন্টিং প্রেসের মালিকরা সরকারকে ব্লাকমেইল করে কিনা জানতে চাইলে এস এম মহসিন বলেন, আমাদের সেই সুযোগ কই? নভেম্বরের ২৫ তারিখে আমাদের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বই ছাপার কাজ দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার কাজ দিয়েছে ৯ ডিসেম্বর। আর নবম শ্রেণির বই ছাপার কাজ পেয়েছি ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে। ফলে যে সময় আমাদের দেওয়া হয়েছে, তাতে বসে থাকার সুযোগ কই? এগুলো বলার জন্য বলা। আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব ভালো কাগজে বই ছাপানোর।’শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, শিশুদের কাছে বই যাবে, সেটা ভালো কাগজে ছাপা না হলে তো হয় না। সেজন্য উন্নতমানের ছাপা, উন্নত মানের কাগজ ও মলাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া এনসিটিবিতে আগে যারা কাজ করেছেন, তাদের অনেককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের বসানো হয়েছে, তারা অনভিজ্ঞ। কিন্তু মুদ্রণ শিল্প সমিতির যে নেতা, তাদের সঙ্গে কীভাবে বোঝাপড়াটা করতে হয়, এটা তাদের অভিজ্ঞতায় নেই। সেটা করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও এর মধ্যে ঢুকতে হয়েছে। কাগজের মান ঠিক রাখা এবং আমাদের বই ছাপানোর কাজ বাদ দিয়ে যাতে নোট বই ছাপার কাজ না হয়, সে বিষয় তদারকির জন্য ঢাকার শিক্ষকদের পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার টিমের মাধ্যমেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বই ছাপানোর কাজে পদে পদে ষড়যন্ত্র ছিল, যা অতিক্রম করা হয়েছে। আজও কোনো কোনো জেলায় ষড়যন্ত্র করে বই আটকিয়ে রাখা হয়েছিল।’
ষড়যন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘গল্পের একেবারে শেষে না গিয়ে যেমন ষড়যন্ত্রকারীকে বোঝা যায় না, এখানেও তেমন। সেটা সরকারের কেউ হোক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হোক, এনসিটিবির হোক, মজুতদার হোক, সিন্ডিকেট হোক- মানে যে কেউ হতে পারে। তবে এখনই আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে আমরা একচেটিয়া ব্যবসা কমিয়ে আনবো। এটা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।’এনটিসিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘আমরা আশা করছি, এখন প্রতিদিনই এক থেকে দেড় কোটি বই ছাপা হবে। সেই হিসেবে আগামী ২০ তারিখের মধ্যে সবগুলো বই আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে দিতে পারবে। এখন মোটামুটি চার কোটি বই ট্রাকে ওঠার অপেক্ষায়। ৫ জানুয়ারি প্রাথমিক ও নবম শ্রেণির সব বই, ১০ জানুয়ারি মাধ্যমিকের আটটি বই এবং ২০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই পাঠানোর চেষ্টা করব।’ তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলছেন, ‘সব বই দিতে ৩০ জানুয়ারি হয়ে যেতে পারে।’