Image description

দেশের সুপ্রাচীন ও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। যেখানে মুক্তচিন্তা, জ্ঞানচর্চা ও প্রগতির আশ্রয় সন্ধানে সারা দেশ থেকে পড়তে আসেন হাজারো শিক্ষার্থী। অথচ জ্ঞানচর্চার সেই প্রাণকেন্দ্র সম্প্রতি পরিণত হয়েছে ভবঘুরে, মাদকাসক্ত ও বহিরাগতদের আখড়ায়। এতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হলেও টনক নড়ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

গত ২৫ মে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাবির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে গাঁজা সেবনের সময় চার বহিরাগতকে হাতেনাতে ধরে প্রক্টরিয়াল টিমের হাতে তুলে দেন কয়েকজন সচেতন শিক্ষার্থী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আটকদের মধ্যে ছিলেন তিনজন তরুণ এবং একজন তরুণী। পরে তাদের শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হলে থানা সূত্র জানায়, গাঁজা হাতে ধরা না পড়লেও সেবনের উদ্দেশ্যেই এসেছিল তারা।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বহিরাগত, মাতাল-ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের আশ্বাসের পরও ঢাবি ক্যাম্পাসে রাত বাড়লেই ফুটপাত থেকে শুরু করে উন্মুক্ত স্থানে আশ্রয় নেয় তিনশর বেশি ভবঘুরে ও উদ্বাস্তু। রাত ১২টার পর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যেন রূপ নেয় অন্য এক জগতে, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হয়ে ওঠে এক উদ্বাস্তু শিবির।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে, রাজু ভাস্কর্য, মল চত্বর, হাকিম চত্বর, শহীদ মিনার এলাকা, এমনকি নারী হলগুলোর সামনেও রাতে ঘুমিয়ে থাকে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ অগণিত ভবঘুরে। কেউ টানিয়ে নেয় মশারি, কেউবা কাপড় দিয়ে গুঁজে তুলেছে অস্থায়ী ঘর। ফুটপাতে খেয়ে সেখানেই মলত্যাগ করছে তারা। দিনের বেলায় এদের অনেকেই ব্যস্ত থাকে ভিক্ষাবৃত্তি ও মাদক সেবনে।

সরেজমিনে দেখা যায়, শাহবাগ থেকে শুরু করে রাজু ভাস্কর্য, কার্জন হল হয়ে শিক্ষা ভবন পর্যন্ত মেট্রোরেল উড়ালপথের নিচে গড়ে উঠেছে উদ্বাস্তুদের ৫০টির অধিক শিবির। এ চিত্র দেখে যে কারো মনে হতে পারে এটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নয়, যেন উদ্বাস্তুদের আশ্রয়কেন্দ্র।

রাজু ভাস্কর্য থেকে বাংলা একাডেমির দিকে হেঁটে যেতেই দেখা যায় ফুটপাতে শুয়ে আছে একদল ভবঘুরে। তন্মধ্যে কয়েকজনকে দেখা যায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায়।

এই চিত্র আরো বেশি ভয়াবহ হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল এলাকায়। কার্জন হলের চতুর্পাশে নাজুক অবস্থা হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভুগছেন এসব হলের নারী শিক্ষার্থীরা। হেনস্তার শিকার হওয়ার অভিযোগ এখন তাদের নিত্যদিনের ঘটনা।

নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে হলটির আবাসিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার বলেন, একদিন মাগরিবের পর শিক্ষা ভবন হয়ে টিউশনি থেকে হলে ফিরছিলাম। হঠাৎ রাস্তার ধারে বসে থাকা এক লোক আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে। এক পর্যায়ে সে আমাকে চেনে উল্লেখ করে আমার হাত ধরে ফেলে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার করতে থাকি এবং সেখান থেকে দৌড়ে হলের দিকে চলে আসি। পরে ওই ব্যক্তি দৌড়ে বিপরীত দিকে চলে যায়।

শারমিন বলেন, এসব এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে কারো কোনো উদ্বেগ নেই।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, শুধু ভবঘুরে নয়, ক্যাম্পাসজুড়ে অবাধে চলছে বহিরাগত যানবাহন। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, বাইসাইকেল, এমনকি মোটরবাইক পর্যন্ত অনায়াসে চলাফেরা করছে একাডেমিক এরিয়া ও হলের সামনের পথঘাটে। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং দায়সারা মনোভাব শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।

ঢাবির স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী মাহবুব খান বলেন, প্রশাসন বলে, এসব রাস্তা নাকি সিটি করপোরেশনের। কিন্তু এখন তো একাডেমিক এরিয়াও যানজটে ভরে গেছে। আমাদের নিরাপত্তার কথা কে ভাববে?

এদিকে গত ১৩ মে দিবাগত রাতে নিজ ক্যাম্পাসেই দুর্বৃত্তদের আক্রমণে নির্মমভাবে নিহত হন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ১৮-১৯ সেশনের মেধাবী শিক্ষার্থী এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির নেতা এসএম শাহরিয়ার আলম সাম্য। তিনি ছিলেন ছাত্রদলের স্যার এ এফ রহমান হল শাখার সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তোফাজ্জল হোসেন নামে এক ভবঘুরেকে।

এসব ঘটনার পর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে বারবার আলোচনা-সমালোচনা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখাতে পারেনি ঢাবি প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।

জানতে চাইলে প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ বলেন, ঢাবি ক্যাম্পাস ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় এসব বিষয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের বেগ পেতে হয়। তবে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, প্রশাসন প্রতি রাতেই ভবঘুরেদের তাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এ প্রক্রিয়া আরো ১০-১২ দিন চলবে।

তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ শুধুই লোক দেখানো এবং তাৎক্ষণিক; বাস্তবে তার কোনো স্থায়ী ফল নেই। কর্তৃপক্ষের সব উদ্যোগ কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল নেতা তানবীর বারী হামীম বলেন, সাম্য হত্যার পরও প্রশাসন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। এখনো একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে চলেছে। অথচ প্রশাসন নির্বিকার।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের একাংশ। তারা বলছে, নিরাপত্তা মানে শুধু বহিরাগত উচ্ছেদ নয়, এটি একটি সমন্বিত ব্যবস্থা, যা ঢাবি প্রশাসন দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।

এক সময় যে ক্যাম্পাস ছিল দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার, আজ সেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরই নিরাপদ ভাবতে পারছে না। এ অবস্থা শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব সংকটেরও ইঙ্গিত দেয়। ঢাবি প্রশাসনের এমন নিষ্ক্রিয়তা যেন পুরো জাতির কাছে এক জবাবদিহিহীন ব্যর্থতার দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।