Image description

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নানা ধরনের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়। এর ধারাবাহিকতায় ৯ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কারে একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়।

এই কমিটির সদস্যরা সবাই এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ ও নাসির উদ্দিন আহমেদও। গত ২২ ডিসেম্বর কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। এ পর্যন্ত সবকিছুই স্বাভাবিক ও ইতিবাচকভাবে অগ্রসর হচ্ছিল। এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারপক্ষ এবং সুশীল সমাজ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়।

তবে নাটকীয়তা শুরু হয় সেই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর থেকেই। কারণ, অজ্ঞাত কারণে প্রতিবেদনটি সরকার এখনও প্রকাশ করেনি। সন্দেহ শুরু সেখান থেকেই। যদিও গণমাধ্যমে যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ পেয়েছে, তাতে কোনো বৈষম্যমূলক বা বিতর্কিত সুপারিশ চোখে পড়েনি এনবিআর কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের।

 

তবে গত ১৩ এপ্রিল যখন এনবিআর বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ গঠনের খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশিত হয়, তখন থেকেই এনবিআর সংশ্লিষ্টদের মধ্যে গুঞ্জন ও ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। 

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, এই খসড়া অধ্যাদেশ ছিল ‘বিনা মেঘে বজ্রপাতের’ মতো। কারণ, এটি পূর্বের কোনো খসড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশের সঙ্গেও এর সাদৃশ্য ছিল না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। কর ও কাস্টমস অ্যাসোসিয়েশনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সংশ্লিষ্টরা তাদের পর্যবেক্ষণ সরকারের উচ্চপর্যায়ে পৌঁছানোরও চেষ্টা চালান।

এই পরিস্থিতিতে ৩০ এপ্রিল এফবিসিসিআই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘অধ্যাদেশ হয়ে গেছে, এখন আমি আর কিছু করতে পারব না।’ কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। কারণ, ১৩ এপ্রিল যেটি জারি হয়েছিল, তা ছিল কেবল একটি খসড়া অধ্যাদেশ। মূল ও চূড়ান্ত অধ্যাদেশটি জারি করা হয় ১৩ মে দিবাগত রাতে, যা পরবর্তীতে ‘মধ্যরাতের অধ্যাদেশ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। 

উদ্বেগ প্রকাশ করে অধ্যাদেশটি স্থগিত করে অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সম্ভাবনা ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি

মূলত এরপর থেকেই এনবিআরের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের ডাক আসে। কর ও কাস্টমস ক্যাডারের বিদ্যমান অ্যাসোসিয়েশন বিষয়টি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সেটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং এর পরিবর্তে গঠিত হয় ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’, যাতে রাজস্ব বিভাগের সব স্তরের কর্মচারীরা একত্রিত হন।

ঐক্য পরিষদের অভিযোগ, পরামর্শক কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে-একটি ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ এবং অন্যটি ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’। এই প্রক্রিয়াকে অবৈধ ও একতরফা উল্লেখ করে এনবিআরের অধীন কাস্টম হাউস, শুল্ক স্টেশন, কর অঞ্চল ও ভ্যাট কমিশনারেটগুলোতে তিন দিনের কলম বিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়।

এর ধারাবাহিকতায় ১৪, ১৫, ১৭, ১৮ ও ১৯ মে পর্যন্ত কলম বিরতি পালন করেন রাজস্ব কর্মকর্তারা।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ তিনটি প্রধান দাবি তুলে ধরে। যার মধ্যে রয়েছে- অধ্যাদেশ বাতিল করা, পরামর্শক কমিটির সুপারিশ প্রকাশ এবং সকল অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে প্রকৃত ও টেকসই রাজস্ব সংস্কার করা।

এদিকে অর্থনীতিবিদ ও রাজস্বনীতি-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে মত দিয়েছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং অধ্যাদেশটি স্থগিত করে অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে সম্ভাবনা ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগের পেছনের নীতিগত সিদ্ধান্তকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই। রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশ পাশ কাটিয়ে হঠাৎ করে এই অধ্যাদেশ জারি করার উদ্দেশ্য কী? কার স্বার্থে এই সুপারিশসমূহ উপেক্ষা করা হলো?’

তিনি বলেন, ‘এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজস্ব বোর্ডের বিকেন্দ্রীকরণের নামে সরকারের, বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক উন্নত চর্চা অনুযায়ী, রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য একটি আইনি সুরক্ষাপ্রাপ্ত, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত স্বতন্ত্র সংস্থা থাকা জরুরি। কিন্তু পরামর্শক কমিটির মূল সুপারিশকে উপেক্ষা করে এখন এনবিআরকে দুই ভাগ করে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

এদিকে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এনবিআরকে দুই ভাগ করার ধারণাকে নীতিগতভাবে সমর্থন করলেও, প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। 

তিনি বলেন, ‘এনবিআরকে দুই ভাগ করার প্রস্তাব আমাদের শ্বেতপত্রে সুপারিশ আকারে ছিল। তবে এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি সঠিক হয়নি। আলোচনা ছাড়া, পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ সংকুচিত করে এবং অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ন্ত্রণে রেখে এভাবে সংস্কার বাস্তবায়ন গ্রহণযোগ্য নয়। এখন এই ভুলগুলো সংশোধন করা জরুরি।’

সর্বশেষ আংশিক কলম বিরতি কর্মসূচির প্রেক্ষিতে ২০ মে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের আশ্বাসে সাময়িকভাবে কলম বিরতি স্থগিত করেন আন্দোলনকারী রাজস্ব কর্মকর্তারা। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৩টায় সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টার পাশাপাশি জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল খান, বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ান হাসান এবং অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

তবে বৈঠক শেষে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ দাবি করে, সভা ফলপ্রসূ হয়নি এবং তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। যদিও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে যেভাবে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তা বহাল থাকবে। এ নিয়ে যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল, তা দূর হয়েছে।’ 

কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। এরপর থেকে আন্দোলনের নতুন রূপ নেয় অসহযোগ কর্মসূচি। দাবি উঠতে থাকে-বিতর্কিত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করে রাজস্ব সংস্কার পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসমক্ষে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। এছাড়া এনবিআর চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে। একইসঙ্গে চার দফা দাবিতে বুধবার (২১ মে) এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে অসহযোগ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়।

আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২২ মে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। একই দিন এনবিআর ভবনসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। পরবর্তী কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৪, ২৫ ও ২৬ মে-তিন দিনব্যাপী পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে। তবে কাস্টমস হাউস এবং এলসি স্টেশনসমূহ এই কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে, যাতে রপ্তানি কার্যক্রম ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ব্যাহত না হয়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐক্য পরিষদের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দাবি পানির মতো পরিষ্কার। রাজস্ব নিয়ে লুকোচুরি ও অপরাজনীতি আমরা মানি না। পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসমক্ষে প্রকাশ করুন। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিন, সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কার করুন। 

তারা বলেন, আমরা যদি কোনো দুর্নীতিতে জড়িত হই, তদন্ত করে শাস্তি দিন। আমাদের জবাবদিহিতা আরও কঠোর করুন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে এই সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দেওয়া ও নতুন কাঠামোর বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের মধ্যেও বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। তারা বলছে, আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে কখনও দুর্নীতির অভিযোগ, কখনও রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে।

একাধিক নেতা বলেন, ‘আমাদের কখনো দুর্নীতিবাজ বলা হয়েছে, কখনো ‘হাসিনা-সমর্থক’ বা ছাত্রলীগের ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে আমরা নাকি সেপারেশন, সংস্কার কিংবা অটোমেশন চাই না। অথচ এনবিআরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই এই দাবিগুলো বহু আগে থেকেই জানিয়ে আসছে।’

তারা বলেন, ‘এনবিআরের যে পরিমাণ অটোমেশন হয়েছে, তা মূলত মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্যোগেই হয়েছে। টেকনিক্যাল ক্যাডারে নন টেকনিক্যাল ও তথাকথিত সিভিল সার্ভিসধারীদের বসিয়ে আর দেশ ও দেশের মানুষের সর্বনাশ করবেন না। তথাকথিত এই সিভিল সার্ভিস ধারীরাই আজ দেশের বারোটা বাজিয়েছে সেটা সবাই জানে। বিগত ৩১ জন এনবিআর চেয়ারম্যানের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হবে, বেশিরভাগই রাজস্ব প্রশাসন বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়াই দায়িত্ব পালন করেছেন। যার ফলে কাজ করতে গিয়ে অথৈ সাগরে পড়তে দেখা গেছে।’

এ বিষয়ে এনবিআর সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউই মন্তব্য দিতে রাজি হননি। অনেকে এই মুহূর্তে গণমাধ্যমে কথা বলতে অপারগ বলে জানান।