
মা-বাবার একমাত্র কন্যা শারমিন আহমেদ (২৫) গত বছর অনার্স শেষ করেন। দেখতে সুন্দর বলে কলেজ থেকেই শারমিনের বিয়ের প্রস্তাব আসছিল। কিন্তু ভালো পাত্রের খোঁজে ছিলেন শারমিনের অভিভাবক। গত বছরের শেষে এক চিকিৎসক পাত্রের সঙ্গে তারা শারমিনের বিয়ে দেন। এখানে পাত্রের যোগ্যতা হিসেবে পরিবারের একমাত্র সন্তান ও পারিবারিক সচ্ছলতার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। তাই মেয়ের বিয়েতে আর দেরি করেননি শারমিনের মা-বাবা। কিন্তু শারমিনের স্বামী ছিলেন মাদকাসক্ত। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের মুখে পড়েন। শারমিনের নিজ থেকে সংসারের কোনো দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা ছিল না। এমনকি সামান্য কিছু কিনলেও তাকে জবাবদিহিতা করতে হয়। সন্তানের এই কষ্ট দেখে মা-বাবা তাকে নিজেদের কাছে ডেকে পাঠান। শারমিন সম্প্রতি বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। শারমিনের মতো সংসার শুরুর বছর না পেরোতেই বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। শুরু না করতেই সংসার ভাঙছে তাসের ঘরের মতো। মতের অমিল হওয়া, আর্থিক অসচ্ছলতা, শ্বশুরবাড়ির লোকদের নেতিবাচক আচরণ এই বিষয়গুলো এখন শিক্ষিত দম্পতিদের কাছে সংসার করার ক্ষেত্রে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবার গ্রামীণ এলাকাতে অনেক দিনের পুরোনো সংসারও ভেঙে যাচ্ছে। এখানে পারিবারিক চাপ ও স্বামীর দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার মতো বিষয়গুলো বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে, দেশে গ্রাম এলাকায় এখন শহর এলাকার চেয়ে বেশি বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। আবার নারীরা পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি হারে বিচ্ছেদের আবেদন করছেন বা বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন। বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ হিসেবে পরকীয়া, সংসার না করা, ভরণপোষণে অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, পুনর্বিবাহর মতো কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলছেন, মানুষের মধ্যে আগের চেয়ে সহনশীলতা কমে যাওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি, স্ত্রীকে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং ভরণপোষণ দেওয়া হচ্ছে না এমন কারণ দেখিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করা হচ্ছে। নারীদের ক্ষেত্রে তারা আগের তুলনায় স্বাধীনচেতা বেশি হওয়ায় এবং স্বাবলম্বী হওয়ায় বিচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২৪ সালের বিবাহবিচ্ছেদের হিসাব বলছে, এ বছর ১২ মাসে বিভিন্ন অঞ্চলে মোট ৭ হাজার ৯১৩টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে নারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মোট ৫ হাজার ৭৬৪টি বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। আর পুরুষদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২ হাজার ১৪৯টি বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ এখানে নারীরা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)-এর তথ্যে, গত বছর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে গড়ে ২ হাজার ৫২১টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৬১টি বিচ্ছেদের আবেদন করেন নারীরা। আর ৯৬০টি আবেদন করেন পুরুষরা। মোট বিচ্ছেদ কার্যকর হয় ১ হাজার ৫০৮টি।
বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামের মানুষ শহরের মানুষের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি বিচ্ছেদ ঘটান। দেশের বিভিন্ন জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিবাহবিচ্ছেদ হয় খুলনায়। এ বিভাগে প্রতি ১ হাজার মানুষের বিপরীতে বিচ্ছেদের অনুপাত ১ দশমিক ৯০ জন। এরপরই বিভাগ অনুযায়ী বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি হয় রাজশাহীতে। এখানে প্রতি ১ হাজার মানুষের বিপরীতে বিচ্ছেদের হার ১ দশমিক ৭ জন। দেশে সিলেট বিভাগে বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে কম। এ বিভাগে প্রতি ১ হাজার মানুষের বিপরীতে বিচ্ছেদের হার শূন্য দশমিক চারজন। চট্টগ্রাম বিভাগেও বিচ্ছেদের হার অন্য বিভাগের চেয়ে কম। এতে উল্লেখ করা হয়, সবচেয়ে বেশি ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি নারী ও পুরুষরা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান বা বিচ্ছেদের আবেদন করেন।
এ প্রতিবেদনে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরকীয়ার (২২ দশমিক ৪ শতাংশ) জন্য বিচ্ছেদ ঘটে। এ জন্য চট্টগ্রাম এলাকায় সবচেয়ে বেশি এরপর ঢাকায় বিচ্ছেদ বেশি হয়। আর সংসার না করার জন্য (২০ দশমিক ১ শতাংশ) বিচ্ছেদ ঘটান। ভরণপোষণের ব্যয় বহনে অস্বীকৃতির জন্য (১২ দশমিক ৮ শতাংশ) এবং পারিবারিক চাপের জন্যও (১১ দশমিক ৯ শতাংশ) বিচ্ছেদ ঘটনা ঘটে। অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে-জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করতে অক্ষম, যৌন মিলনে অনীহা বা অক্ষম, পুনর্বিবাহ করা। আবার দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয় সিলেট এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দিন যত যাচ্ছে বিবাহবিচ্ছেদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সমাজ যত আধুনিক হচ্ছে তত ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবাদ বাড়ছে এতে বিয়ের মতো দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠান সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। নগরায়ণের কারণে এখন স্বামী ও স্ত্রী আলাদা জায়গায় থাকছেন। কাজের জন্য অনেক স্বামী-স্ত্রী প্রবাসে থাকছেন।
দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও একটা প্রভাব পড়ছে। একজন নারী যদি আর্থিক স্বনির্ভরতার কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে তখন দাম্পত্যে সমঝোতার জায়গা না থাকলে বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটে। আবার দাম্পত্যে পারস্পরিক আস্থাহীনতা, পরকীয়ার মতো ঘটনাগুলোও বিচ্ছেদের জন্য দায়ী। আগে বিচ্ছেদের আগে পরিবারের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হতো যা এখন হয় না। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সমঝোতার মধ্যেও ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। পারিবারিক মূল্যবোধের চর্চার জায়গাগুলো ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে।