
জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, এ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছেন।
অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে কথা না বলতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীজন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেতা সারজিস আলম। নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে আজ বুধবার (২১ মে) সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে দলটি।
ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে স্পষ্ট দিন তারিখ সামনে আসেনি। তবে নির্বাচন যখনই হোক না কেন জাতীয় নির্বাচনের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হয়েছে, কিছু আবার বাকি রয়েছে।
মোটাদাগে নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে আছে—ছবিসহ একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, সীমানা নির্ধারণের পরে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দেওয়ার মতো কাজগুলো। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই শেষ করতে হয়। আর কিছু প্রস্তুতি নিতে হয় তফসিল ঘোষণার পর।
‘আমাদের বড় কাজ হচ্ছে একটা স্বচ্ছ ভোটার তালিকা, যা সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া বাকি কাজগুলো করতে ইসির বেশি সময় লাগবে না। জাতীয় নির্বাচনের জন্য ইসির অনেক প্রস্তুতি আগে থেকেই রয়েছে। সরকার চাইলে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’ -ইসি সচিব আখতার আহমেদ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বড় কাজের মধ্যে একটি হলো স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, যেটা শতভাগ সম্পূর্ণ করেছে নির্বাচন কমিশন। বাকি কাজগুলো চলমান রয়েছে। বর্তমানে যে সব কাজ বাকি আছে তা স্বল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারবে ইসি। তবে কাজগুলো কতটা দ্রুত সম্পন্ন হবে তা নির্ভর করছে সরকারের সবুজ সংকেতের ওপর। সরকার যদি জাতীয় নির্বাচনের জন্য সবুজ সংকেত দেয় তবে সেই হিসেবে ইসি শতভাগ প্রস্তুত হবে। মোটাদাগে জাতীয় নির্বাচনের জন্য এক ধরনের প্রস্তুত ইসি। সরকার থেকে সবুজ সংকেত পেলে বাকি কাজগুলো তফসিল ঘোষণার আগে পরেই সম্পন্ন করতে পারবে ইসি। তবে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি শেষ করে আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করার চিন্তা করছে সাংবিধানিক এই সংস্থা।
সরকার চাইলে কবে নাগাদ জাতীয় নির্বাচন করতে পারবে ইসি? এই প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব আখতার আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার যেভাবে বলবে আমরা সেভাবে প্রস্তুত আছি। সরকার যদি দ্রুত প্রস্তুত হতে বলে তবে বাকি কাজ তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমাদের বাড়তি সময় নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকার নিশ্চয় একটা সময় নিয়ে আমাদের বলবে তখন আমরা সেইভাবে কাজ করবো। তবে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি কিন্তু একটা চলমান প্রক্রিয়া। যেমন কেউ দুই দিন আগে ভোটার হতে পারে না আবার দুই দিন পরে ভোটার হতে পারে। তখন তাকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবো। আমাদের বড় কাজ হচ্ছে একটা স্বচ্ছ ভোটার তালিকা, যা সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া বাকি কাজগুলো করতে ইসির বেশি সময় লাগবে না। জাতীয় নির্বাচনের জন্য ইসির অনেক প্রস্তুতি আগে থেকেই রয়েছে। সরকার চাইলে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
জাতীয় নির্বাচন কবে নাগাদ আয়োজন করতে সক্ষম ইসি এই প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন একটা প্রক্রিয়া। বেশ কিছু কাজ আমাদের করতে হয় যা সময়সাপেক্ষ। কিছু প্রকিউরমেন্ট রয়েছে যা আট লটে সম্পন্ন হবে। আরও কিছু কাজ করা হবে যেমন ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ।’
দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৭ লাখ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ স্বচ্ছ ভোটার তৈরির কাজ। এই কাজ শতভাগ সম্পূর্ণ করেছে ইসি। দেশে বর্তমানে মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৩৩ লাখ ৬১ হাজার ৬১৫। নারী ভোটার ৬ কোটি ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৬৫।
উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশ
‘জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ–২০২৫’–এর অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। তবে এখনো গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। ৬১টি সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তনের জন্য আবেদন পেয়েছে ইসি।
ইসি জানায়, এখন পর্যন্ত ৬১টি সংসদীয় আসনের বিষয়ে ৪০৫টি আবেদন এসেছে। একেকটি আসনে একাধিক আবেদনও আছে। গেজেট পেলে কাজ শুরু হবে। যত দ্রুত সম্ভব, আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করবে ইসি।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের কাজ চলমান
নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন চেয়ে গত ১০ মার্চ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল ইসি। আবেদনের শেষ সময় ছিল ২০ এপ্রিল। কিন্তু নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ ৪৬টি দল সময় বাড়ানোর আবেদন করে। এরপর ২২ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ায় ইসি। এর পরেই নিবন্ধনের কাজ সম্পন্ন হবে। জাতীয় ভূমিহীন পার্টি, বাংলাদেশ বেকার সমাজ পার্টি, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি, বাংলাদেশ শান্তির দল, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টির মতো ৬৫টি দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে আগ্রহী।
আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করায় এখন ইসিতে নিবন্ধিত দল আছে ৪৯টি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৯৩টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। তবে বেশির ভাগ দলই ছিল নামসর্বস্ব। প্রাথমিক কাগজপত্র বাছাইয়েই বাদ পড়েছিল ৮১টি দলের আবেদন।
নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ নিরাপত্তা, সেপ্টেম্বরে শুরু কর্মপরিকল্পনা
ইসির নিজস্ব প্রস্তুতির বাইরে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশসানের ভূমিকা। নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ এখনো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। এছাড়া আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। দলটির নেতাকর্মীরা ভোটে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু হবে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ।
জাতীয় নির্বাচনে প্রয়োজনীয় কেনাকাটার প্রস্তুতি
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় কাগজ কেনাকাটা ও মুদ্রণ কাজ ভোটের আগে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে করার প্রস্তুতি রাখছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের সামগ্রী চাহিদা নিরূপণ, সম্ভাব্য বাজেট ও মজুদ যাচাই নিয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে ইসি।
ইসি কর্মকর্তারা বলেন, সংসদ নির্বাচনে ২১ প্রকার ফরম, ১৭ প্রকার প্যাকেট, পাঁচ প্রকার পরিচয়পত্র, আচরণবিধি, প্রতীকের পোস্টার, নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়াল, প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, নির্দেশিকাসহ অনেক কিছু মুদ্রণ করতে হয়। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব মুদ্রণ করে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথাও চিন্তা করছে ইসি। সে ক্ষেত্রে মে মাসের মধ্যে কেনাকাটা শুরু করতে হবে। তফসিল ঘোষণার পর মনোনয়নপত্র এবং প্রতীক বরাদ্দ হলে প্রার্থীর নাম ও প্রতীক নিয়ে ব্যালট পেপার মুদ্রণ রয়েছে। যেগুলো মাঠ পর্যায়ে পাঠাতে হয়। সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় এক লাখ ৬১ হাজার রিম কাগজ কেনা হয়েছিল। ৩৩ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছিল। এবার অন্তত এক লাখ ৭০ হাজার রিম কাগজ কেনার প্রয়োজন হতে পারে। শুধু কাগজ কেনায় ৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। এছাড়া ভোটের বাক্সও কেনাকাটার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
‘জাতীয় নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিরাপত্তা। একটা দলের কার্যক্রম স্থগিত, তারা চুপ করে বসে থাকবে না। তারা নানাভাবে নির্বাচনী মাঠে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। তারা নানাভাবে ইন করবে এই চ্যালেঞ্জে। ইসি একটি খসড়া কর্মপরিকল্পনা করেছে, আগামী জুন-জুলাই নাগাদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হতে পারে।’ – নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম
জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের নিয়ে নতুন নীতিমালা
আসন্ন জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ওয়েব)। গত ১৪ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনের কাছে আবেদনপত্রটি জমা দেন ওয়েবের নেত্রীরা। এবার সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশীয় পর্যবেক্ষকদের জন্য এইচএসসি বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে চায় নির্বাচন কমিশন। সেই সঙ্গে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০২৩ সালের নীতিমালা বাদ দিয়ে ‘একই আদলে’ নতুন পর্যবেক্ষক নীতিমালা করা হচ্ছে।
বর্তমানে ৯৬টি পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধিত রয়েছে ইসিতে। এগুলোর নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যাবে। আগ্রহী সংস্থাগুলোকে নতুন নীতিমালার আলোকে আবেদন করতে হবে। সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সংস্থাগুলোর ২০ হাজারেরও বেশি পর্যবেক্ষক ছিল। নীতিমালা অনুযায়ী এসএসসি বা সমমান পাস করলেই পর্যবেক্ষক হওয়ার সুযোগ ছিল। নতুন পর্যবেক্ষকদের আবেদন চলমান। এটা শেষ হতে আরও সময় লাগবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ইসির প্রস্তুতি প্রসঙ্গে কথা হয় নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীমের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মতে ইসি ভালোই প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের বড় দুটি কাজ প্রায় হয়ে গেছে, একটা স্বচ্ছ ভোটার তালিকা, আরেকটি সীমানা নির্ধারণ। এই দুটি কাজ ছাড়া বাকিগুলো সম্পন্ন করতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সরকারের সবুজ সংকেত পেলে দ্রুতই ইসি জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারবে। বাকি কাজগুলো পাঁচ মাসে সম্ভব। প্রশিক্ষণ, কেনাকাটা, সংলাপ এগুলোতে বেশি সময় লাগবে না। সরকারের সবুজ সংকেত পেলে কমিশনও বাকি কাজ দ্রুত করতে উদ্যোগ নেবে।’
জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে আব্দুল আলীম বলেন, জাতীয় নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিরাপত্তা। একটা দলের কার্যক্রম স্থগিত, তারা চুপ করে বসে থাকবে না। তারা নানাভাবে নির্বাচনী মাঠে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। তারা নানাভাবে ইন করবে এই চ্যালেঞ্জে। ইসি একটি খসড়া কর্মপরিকল্পনা করেছে, আগামী জুন-জুলাই নাগাদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হতে পারে। বর্তমানে কাজের যে পরিস্থিতি তাতে এটা সম্ভব।’
উৎস: জাগোনিউজ২৪