Image description

ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে ঘর ছেড়েছিলেন শরীয়তপুরের আলতাফ হোসেন ছৈয়াল ও আহসান উল্লাহ বলী। ফিরে এসেছেন ঋণের বোঝা আর ভয়াবহ নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। বেঁচে ফিরবেন ভাবেননি তারা। লিবিয়ার ভয়ংকর দিনগুলো থেকে মুক্তি পেতে দুজনকে মুক্তিপণ বাবদ গুনতে হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও ইউনিয়নের মনুয়া এলাকার দুলাল ছৈয়ালের ছেলে আলতাফ হোসেন ছৈয়াল (৩০) ও আইজারা এলাকার আবদুল গনি বলির ছেলে আহসান উল্লাহ বলী (৩০)। সোমবার (১৯ মে) দুপুরে আইজারা এলাকার বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল আহসান উল্লাহ বলীর সঙ্গে। সেখানে দুই তরুণের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, আলতাফ হোসেন ছৈয়ালের বাবা দুলাল ছৈয়াল দালালের কথায় আস্থা রেখে ছেলে আলতাফকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠানোয় মত দিয়েছিলেন। দালাল বলেছিলেন, ইতালিতে বেতন পাবেন মোটা অঙ্কের। এ জন্য লাগবে অনেক টাকা। তাই আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা, এনজিও-ব্যাংক থেকে ঋণ এনে ও বাড়ি-জমি বিক্রি করে দফায় দফায় দালালের হাতে টাকা তুলে দেন। কথা ছিল দুবাই, মিসর হয়ে ছেলেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দেবেন তারা। সেখান থেকে ইতালি যাবেন তিনি। অথচ বাড়ি থেকে বের হওয়ার ৮ মাস পর লিবিয়ায় বন্দিদশা থেকে বাড়ি ফিরেছেন আলতাফ। সেই সঙ্গে গেছে তার ধারদেনার ৬৫ লাখ টাকাও।

এ ঘটনায় বাড়ি ফিরে আহসান উল্লাহ বলী বাদী হয়ে ছয়গাঁও বাংলা বাজার এলাকার হারুন লস্কর তার ছেলে পাপ্পু লস্কর ও ইমন লস্করের বিরুদ্ধে ভেদরগঞ্জ থানায় একটি অভিযোগ করেছেন। ভেদরগঞ্জ থানার ওসি পারভেজ আহমেদ বলেন, শুক্রবার সকালে একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করব। তদন্তের সত্যতা পেলে মামলা হবে।

ভুক্তভোগী আলতাফ হোসেন বলেন, ছয়গাঁও বাংলা বাজার এলাকার দালাল হারুন লস্করের বড় ছেলে পাপ্পু লস্কর ইতালি ও ছোট ছেলে ইমন লস্কর লিবিয়া থাকেন। তাই আমার বাবাকে নানা প্রলোভন দেখাতে থাকেন দালাল হারুন। সংসারের অভাবের কথা ভেবে বাবা আমাকে ইতালি পাঠাতে রাজি হন। ১৬ লাখ টাকায় ইতালি নেওয়ার জন্য চুক্তি হয় দালাল হারুন লস্করের সঙ্গে।

তিনি বলেন, প্রথমে অগ্রিম ৪ লাখ দেওয়া হয়েছে হারুনকে। হারুন লস্করের নির্দেশ অনুযায়ী কাগজপত্র জোগাড় করে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা পৌঁছায় আলতাফ। সেখানে ২৪ দিন ছিলেন। পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কা থেকে লিবিয়া বিমানবন্দরে হারুন লস্কর লোকজন তাকে রিসিভ করে গাড়িতে তুলে ছোট একটা বাড়ির কক্ষে ৩০-৩৫ জনকে একসঙ্গে রাখেন। লিবিয়া পৌঁছালে হারুন লস্করের হাতে ১২ লাখ টাকা দেয় তার বাবা।

আলতাফ আরও বলেন, সেখানে দুই দিন রেখে পরে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যান। এমন একাধিক ক্যাম্পে এক মাস ২৬ দিন রাখার পর ১৩ নভেম্বর লিবিয়ার ত্রিপলি সাগর পাড়ে একটি কাঠের নৌকায় ১৬০ জনকে উঠিয়ে ২০ মিনিট ঘুরিয়ে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। পরে চক্রটি পুলিশের কাছ থেকে উদ্ধার করে আবার একটি গোডাউনে নিয়ে যায় তাদের। সেখানে শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। ইতালি নেওয়ার কথা বললেই চলে মারধর। এদিকে বাড়িতে ফোন করে ধাপে ধাপে আদায় করে নেন ২৬ লাখ টাকা। এরপর আবার ২৯ ডিসেম্বর একটি কাঠের নৌকায় ৬০ জনকে উঠিয়ে ৪ ঘণ্টা ঘুরিয়ে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয় চক্রটি। পাঁচ দিন পর পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আরেক চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, এ চক্রটি ৩১ ডিসেম্বর রাতে আবারও ৬৫ জনকে নিয়ে সাগর পাড়ি দেওয়ার পর নৌকায় পানি উঠে যায়। সেখান থেকে চক্রটি তাদের উদ্ধার করে। এরই মধ্যে বাড়িতে ফোন করে ধাপে ধাপে আদায় করে নেন আরও ২৩ লাখ টাকা। সব টাকা দেওয়া হয় দালাল হারুন লস্করের মাধ্যমে। লিবিয়া থেকে ইতালি যাব। অথচ বাড়ি থেকে বের হওয়ার ৮ মাস পর লিবিয়ায় বন্দিদশা থেকে শরীরে ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফিরেছি আলতাফ হোসেন। সেই সঙ্গে গেছে ধারদেনার ৬৫ লাখ টাকাও।

ভুক্তভোগী আহসান উল্লাহ বলী বলেন, লিবিয়া পৌঁছানোর পরই আমাদের সবার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। রাখা হয় একটি অন্ধকার কক্ষে। পালানোর চেষ্টা করায় একটি কক্ষে আটকে রেখে নিয়মিত মারধর করা হতো। দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক, প্লাস দিয়ে উপড়ে ফেলা হতো নখ, পেটানো হতো বৈদ্যুতিক তার দিয়ে। খাবার দিতো না। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত ৭ মে মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়ি আসি।

তিনি আরও বলেন, মানবপাচার চক্রের সদস্য অনেক। বাংলাদেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসীরা তাদের টার্গেট। ভালো চাকরি বা ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে লিবিয়া নিয়ে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করাই হচ্ছে তাদের কাজ। আমার পরিবারের কাছ থেকে ৬৫ লাখ টাকা নিয়েছে তারা।

আহসান উল্লাহ বলী বলেন, অনুরোধ করব, এ মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে আর কেউ যাতে লিবিয়া না যায়। এ ঘটনায় টাকা ফেরত ও বিচার পেতে ভেদরগঞ্জ থানায় দালালদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করেছি।

প্রতারণার শিকার আহসান উল্লাহ বলীর মা লুৎফা বেগম বলেন, আমরা শেষ হয়ে গেছি। ইতালি নেওয়ার কথা বলে আমার ছেলেকে লিবিয়া নিয়ে অত্যাচার করে ওর জীবন শেষ করে দিয়েছে। আমাদের এখন লাখ লাখ টাকা দেনা। পাওনাদাররা বাড়িতে আসলে আমরা পালিয়ে থাকি। আমার পরিবার এলোমেলো করে দিয়েছে ওরা। আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই।

তবে দালাল হারুন লস্কর বলেন, ঢাকা ও ফরিদপুরের লোকজনের মাধ্যমে আমার ছেলেদের বিদেশে পাঠিয়েছি। তাদের ছেলেদেরকেও পাঠিয়েছি। আহসান উল্লাহ ও আলতাফের পরিবারের কাছ থেকে আমি কোনো টাকা নেইনি। এ ব্যাপারে কোনো প্রমাণ নাই।

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ভেদরগঞ্জের দুই তরুণ দালালের মাধ্যমে ইতালির উদ্দেশ্যে লিবিয়া যায়। সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে দেশে ফিরে এসেছে শুনেছি। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু চক্রকে শনাক্ত করেছি। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি।