
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঢোলারহাট গ্রামের কৃষক আবদুল হাকিম পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন। তার পেছনে ভেসে ছিল শত শত পচা আলুর স্তূপ। দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকাই কষ্টকর। গলায় একরাশ হতাশা নিয়ে বললেন- ‘এই আলু আমার স্বপ্ন ছিল। এখন এই আলুই আমার শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
চারদিকেই দেখা মিলল একই দৃশ্যের। রাস্তার ধারে, পতিত জমিতে, এমনকি খাল-বিলেও পড়ে আছে পচে যাওয়া আলুর স্তূপ। বাতাসে ভাসে গন্ধ, আর সেই গন্ধে যেন ছড়িয়ে পড়ছে কৃষকের স্বপ্নভঙ্গের গল্প।জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। এতে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু।
কিন্তু সমস্যা হলো, জেলায় হিমাগার আছে মাত্র ১৭টি, যেগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার টন। অর্থাৎ মোট উৎপাদনের সাড়ে ৬ লাখ টনের বেশি আলু রয়ে গেছে খোলা আকাশের নিচে- কোনো হিমায়নের সুযোগ ছাড়াই।
আঁকচা ইউনিয়নের পুরাতন ঠাকুরগাঁও গ্রামের কৃষক লুৎফর রহমান বললেন, আমার ৫০০ মণ আলু ছিল। হিমাগারে জায়গা পাইনি। টিনের চাল দিয়ে ঘর বানিয়ে রেখেছিলাম। এখন অন্তত ২০০ মণ আলু পচে গেছে। কেউ কিনতেও চায় না। আমরা নিজেরাই নিতে পারছি না।
নারগুন ইউনিয়নের কহরপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম জানান, এক একর জমিতে আলু চাষ করেছি, খরচ পড়েছে ২ লাখ টাকা; কিন্তু এখন বিক্রি করেও পাচ্ছি না ৫০ হাজার টাকা। ব্যাংকের ঋণ আছে, দোকানে বাকিতে সার-বীজ নিয়েছিলাম—সেই টাকা শোধ করব কিভাবে?
হরিপুরের সাইফুল ইসলাম বলেন, হিমাগারের সামনে দুই রাত ঘুমিয়ে ছিলাম, আলু রাখার জায়গা পাইনি। শেষে বাড়ির বারান্দা, রান্নাঘর, এমনকি ঘরের নিচেও আলু রেখেছিলাম। এখন সেগুলোতে পচন ধরেছে। খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু গন্ধে টের পাওয়া যায়।
সালোন্দর ইউনিয়নের চৌধুরীহাট এলাকার কৃষক হাবিবুল ইসলাম বলেন, সরকার যদি কৃষিপণ্য সংরক্ষণ, রপ্তানি ও বাজারজাতকরণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না নেয় তাহলে শুধু ঠাকুরগাঁও নয়, সারা দেশের কৃষক এক সময় আলু চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে।
একসময় এ অঞ্চলের আলু রপ্তানি হতো রাশিয়া, মালয়েশিয়া, নেপাল ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে। সেই সময় দাম ছিল ভালো, কৃষকের মুখে ছিল হাসি; কিন্তু এখন? সরকার কোনো রপ্তানির উদ্যোগ নেয়নি এবার- বললেন ঠাকুরগাঁওয়ের আলু ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম বললেন, চাষিরা এবার উঠোন পর্যন্ত আলু লাগিয়েছে। আমরা আগেই পরামর্শ দিয়েছিলাম যেন কম উৎপাদন করে ভালো দাম পায়; কিন্তু অধিক উৎপাদনে হিমাগারে জায়গা হয়নি। তাই সংরক্ষণের অভাবে পচন ধরেছে।
কৃষি কর্মকর্তার এমন কথায় সদরের বেগুনবাড়ি এলাকার আব্দুল হাকিম বলেন, আমরা চাষ করব না? কে করবে? সরকার পরামর্শ দিলেও কেন সেই অনুযায়ী বাজার বা সংরক্ষণের পরিকল্পনা ছিল না? কেন আলুর ব্যবহার বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না?
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন অনেক সময়ই পরিকল্পনাহীন হয়। কোন ফসল কতটা চাষ হবে, বাজারে চাহিদা কতটা—এসব বিশ্লেষণ ছাড়া চাষ হলে এমন বিপর্যয় ঘটবেই।
তিনি বলেন, উৎপাদনের পূর্বে ক্রয় নিশ্চয়তা বা সরকারি মডেলিং দরকার। রপ্তানি বাজার তৈরি করতে চুক্তিভিত্তিক বাণিজ্য, সংরক্ষণে হিমাগার সম্প্রসারণ ও ভ্রাম্যমাণ কোল্ড স্টোর আলুর প্রক্রিয়াজাত পণ্য (চিপস, ফ্রোজেন ফ্রাই) তৈরিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন।