Image description
 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়ার সঙ্গে যেসব ঠিকাদার জড়িত তার মধ্যে রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির জন্য কালো তালিকাভুক্তি হয়েছিল। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে একের পর এক কাজ পেয়ে যাচ্ছে তারা। গত ৮ মাসে পেয়েছে এলজিইডি, সওজ, পাউবোসহ বিভিন্ন দপ্তরের ২৮০টি কাজ। এসব কাজের মোট দর ৮৩৬ কোটি টাকা। এতক্ষণ বলছিলাম  চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্সের কথা।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঠিকাদারি কাজ বাগাতে শক্ত সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন পিরোজপুরের সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন মহারাজ। এ সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য ছিল মোহাম্মদ ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স। ক্ষমতার পরিবর্তনে মহারাজ পালিয়ে দুবাই গেলেও ইউনুস ব্রাদার্সের আধিপত্য কমেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আওয়ামী আমলের বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমের চেয়েও ধূর্ত ইউনুস ব্রাদার্স। জি কে শামীম অপকর্ম করে গ্রেফতার হলেও ইউনুস ব্রাদার্সের কর্ণধাররা দুই (আওয়ামী লীগ ও অন্তর্বর্তী সরকার) আমলেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাজও পাচ্ছে সমান তালে।

অভিযোগ আছে, প্রতিষ্ঠানটি নিজেরা কাজ কম করে। বেশিরভাগই বিক্রি করে দেয়। সব জেলায়ই তাদের ঠিকাদার প্রস্তুত থাকে। কাজ নেওয়ার আগেই নির্ধারিত টাকার চুক্তিতে ওই ঠিকাদাররা ইউনুস ব্রাদার্সের লাইসেন্স ব্যবহার করে দরপত্র জমা দেয়। কেউ কেউ বলেছেন, ইউনুস ব্রাদার্সকে সামনে রেখে আসল খেলা খেলছে পলাতক মহারাজ।

 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোহাম্মদ ইমরান হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা সব ধরণের আইনকানুন মেনেই ব্যবসা করছি। কাজ না করে বিল তোলার মতো কৌশল আমাদের জানা নেই। আমাদের ৫০ বছরের পুরোনো কোম্পানি। ধাপে ধাপে কাজ করেই আমরা বড় হয়েছি। আসলে একটি মহল আমাদের নামে অপপ্রচার চালিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে।’

আট মাসে ৮৩৬ কোটি টাকার ২৮০টি কাজ পাওয়ার বিষয়টি কি অস্বাভাবিক নয়-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ক্যাপাসিটি ও ক্যাপাবিলিটির বিষয়। গত সরকারের আমলে নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও রাতারাতি হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। আমাদের সব মিলিয়ে এক ফ্লাইওভারের কাজের সমান হয়নি।’

মহারাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। আমরা কোনো কাজ বিক্রি করি না। অংশীদারি চুক্তিতে কেউ কেউ কাজ করেন।’

প্রাপ্ত নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, ৫ আগস্টের পর থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইজি), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ (ইইডি), গণপূর্ত বিভাগ (পিডব্লিউডি) খাদ্য অধিদপ্তর এবং রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেটিভের ২৮০টি ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স। এর মধ্যে এলজিইডির সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৭৩টি কাজ রয়েছে। যার দর ৬০৩ কোটি ১৭ লাখ ৪৪ হাজার ৫৬৬ টাকা।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮১টি কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব কাজের দর ৩৭ কোটি ৯৮ লাখ ৬১ হাজার ৩৯৩ টাকা। পাউবো থেকে পাওয়া ১৫টি কাজের দর ১৭৩ কোটি ৯০ লাখ ৮৮ হাজার ১৬৫ টাকা। এছাড়া বিএডিসি থেকে ৯০ লাখ ৭৯ হাজার ৯৪৯ টাকার ৬টি, গণপূর্তের ১২ কোটি ৮২ লাখ ১৭ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকার ১টি, ইইডির দুটি এবং খাদ্য অধিদপ্তর ও রুরাল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেটিভ থেকে ১টি করে কাজ পেয়েছে এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

জানা যায়, ২৯ এপ্রিল একদিনেই সওজ ও পাউবোর ১১টি কাজ পায় ইউনুস ব্রাদার্স। এর মধ্যে সাতটি কাজ সিরাজগঞ্জের। ৩০ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে একটি করে, ২৭ এপ্রিল সওজ থেকে পিরোজপুরের আরেকটি কাজ পায় এ প্রতিষ্ঠান। ২৪ এপ্রিল পায় মাদারীপুরের একটি কাজ।

২৩ এপ্রিল এলজিইডি বরিশাল ও জামালপুরের দুটি কাজ, ২০ এপ্রিল সওজ ও পাউবো থেকে পিরোজপুরের দুটি, দিনাজপুরে দুটি, চট্টগ্রামের একটি ও গোপালগঞ্জের একটি কাজ পেয়েছে একই প্রতিষ্ঠান। ১৭ এপ্রিল সওজ দিনাজপুর ও নীলফামারীতে নয়টি কাজ পেয়েছে ইউনুস ব্রাদার্স। ১৬ এপ্রিল সওজের গোপালগঞ্জে একটি, ১৫ এপ্রিল দিনাজপুরের তিনটি, ভোলার একটি, হবিগঞ্জের একটি, ১৩ এপ্রিল রাজশাহীর ছয়টি, ১০ এপ্রিল দিনাজপুরের চারটি, ৯ এপ্রিল গোপালগঞ্জের একটি এবং ৮ এপ্রিল সওজ দিনাজপুরের দুটি কাজ পায় প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে ৮ মাসে ২৮০টি কাজ পেয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মান বজায় রেখে এত কাজ শেষ করা সম্ভব না। আবার অন্যের কাছে কাজ বিক্রি করে দিলেও ভালো কাজ হয় না। কারণ, নিম্মমানের কাজ ধরা পড়লে দায় চাপে লাইসেন্স প্রতিষ্ঠানের ওপর। ফলে প্রকৌশলীদের ম্যানেজ করে নয়ছয় কাজের মাধ্যমে টাকা তুলে নিয়ে যায় সাব-ঠিকাদাররা। ইজিপি টেন্ডার হওয়ার পরও কী কারণে একই প্রতিষ্ঠান এত কাজ পাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

জানা যায়, সম্প্রতি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক তদন্তে উঠে আসে প্রকল্পের কাজ না করেই এক হাজার ৬৪৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা তুলে নেয় এলজিইডির পিরোজপুর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়।আওয়ামী আমলের শেষ চার বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া ১৭টি প্রকল্প থেকে এই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের যোগসাজশে মহিউদ্দিন মহারাজ ও তার ছোট ভাই পিরোজপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মেরাজুল ইসলামের সিন্ডিকেট এ কাজে জড়িত। এ সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিল ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স।

প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত এলজিইডির পিরোজপুর নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকেই প্রায় শতকোটি টাকার (৯৬ কোটি ৮৮ লাখ ১ হাজার ৫৪৬ টাকা) কাজ পায়। এর মধ্যে কাজ না করেই প্রায় ৩৮ কোটি টাকার অগ্রিম বিল তুলে নিয়েছে বলে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পিরোজপুরে এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ৩০টি প্রকল্পের কাজ এখনো চলমান অবস্থায় পড়ে আছে। কাজ না করে অর্থ আত্মসাতের খবর প্রকাশ্যে এলে সম্প্রতি কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ ফের শুরু করা হয়েছে।

 

জানতে চাইলে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘ইজিপি টেন্ডারে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। তবে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পিরোজপুরে কাজ না করে ১৭ প্রকল্পের অধীনে ১৬০০ কোটি টাকার বেশি বিল তুলে আত্মসাতের ঘটনা গত সরকারের আমলের। ওই ঘটনা মন্ত্রণালয় তদন্ত করেছে। প্রমাণ পাওয়ার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অধিকতর তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) মামলা করেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোহাম্মদ ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’