
জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদের ওপর হামলায় অংশ নেওয়া পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা ঘুরেফিরে বগুড়াতেই আছেন। এর মধ্যে এক-দুজন বাইরে বদলি হলেও বাকিদের দিয়েই চলছে এখানকার পুলিশ প্রশাসন। এসব কর্মকর্তার বর্তমান কর্মকাণ্ড নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর মিশনে অংশ নেয় পুলিশ বাহিনীর বিপথগামী বেশ কিছু সদস্য। তাদের নেতৃত্ব দেন অ্যাডিশনাল এসপি ছাত্রলীগের প্রতিবন্ধী কোটায় পুলিশে চাকরি নেওয়া স্নিগ্ধ আকতার।
তার পাশাপাশি বেশ কজন ইন্সপেক্টর ছিলেন সেদিন সম্মুখভাগে। এর মধ্যে একজন ইন্সপেক্টর রাকিব হোসেন। যিনি এখনো জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আছেন। গোটা জেলার ১২টি থানা, ৩টি তদন্ত কেন্দ্র ও ফাঁড়িতে আরো বেশ কজন অফিসার রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে ঘুরেফিরে বগুড়াতেই কর্মরত।
তবে পুলিশ সুপারসহ বেশ কজন কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যের পরিবর্তন হয়েছে বলে জেলা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সমগ্র দেশজুড়ে যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে, সেদিনের একটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে আমার দেশ বগুড়া অফিসের হাতে। সেই ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার অদূরে পৌর পার্ক ও তিনমাথা রেলগেটমুখী রাস্তায় অবস্থান নেয় ছাত্র-জনতা।
সে সময় সাতমাথার দিক থেকে পুলিশের একটি দল ইন্সপেক্টর রাকিবের নেতৃত্বে ট্রাফিক বক্সের দিকে অগ্রসর হয়। তখন ছাত্র-জনতা তাদের লক্ষ করে স্লোগান দিতে থাকে। ইন্সপেক্টর রাকিব আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে গুলির নির্দেশ দেন।
তার সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যরা তিনমাথা রেলগেট, পৌর পার্ক ও বনানীর রাস্তার দিকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ও গুলিবর্ষণ করে। এতে বেশ কজন আন্দোলনকারী আহত ও নিহত হন।
নিহত ১৯ জনের মধ্যে বগুড়াতেই প্রাণ হারান অন্তত ১৬ জন। অন্য তিনজন মারা যান ঢাকা ও সাভারে।
রাকিবের যত কর্মকাণ্ড
ভিডিও ফুটেজের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে আমার দেশ। এতে জানা যায়, ইন্সপেক্টর রাকিবের ডাকনাম রঞ্জু। বাড়ি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের কুয়েতপুর গ্রামে। পিতা আব্দুল ওয়াহেদ পেশায় কৃষক। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সরাসরি সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন তিনি।
চাকরি জীবনে হাকিমপুর থানায় কর্মরত অবস্থায় জুয়ার আসর চালানো ও সেখান থেকে অবৈধ অর্থ (ঘুস) গ্রহণের অপরাধের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ায় তাকে চাকরিবিধি অনুযায়ী শাস্তি পেতে হয়। পরে অবশ্য আওয়ামী লীগের সময়ে তিনি পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) হন।
২০২৩ সালের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত এমপি প্রার্থী রিপনের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর তাকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে ইন্সপেক্টর রাকিব আমার দেশকে বলেন, আমি জুলাই বিপ্লবের তিন মাস আগে বগুড়ায় এসেছি। ওই সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ পালন করার চেষ্টা করেছি। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেটা ষড়যন্ত্রমূলক।
ঘুরেফিরে যারা বগুড়ায়
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হারুন ভারতে পালিয়ে গেলেও হারুনের ব্যবসায়িক ভাগিদার ইন্সপেক্টর রাকিবের ব্যবসা এখনো চলছে বেশ ভালোই।
এদিকে জেলার সদর থানার এসআই তয়ন কুমার মণ্ডল (৩ বছর), এসআই ইমতিয়াজ আহমেদ (৩ বছর), শাজাহানপুর থানার এসআই নুরুল ইসলাম (৩ বছর), সোনাতলা থানার এসআই আব্দুল খালেক (৩ বছর), আক্কাস আলী (২ বছর), এএসআই আতিক (৩ বছর), শিবগঞ্জ থানার এসআই ব্রজেন মাহাতো (৩ বছর), এসআই তোজাম্মেল হোসেন (২ বছর), উপশহর ফাঁড়ির ইনচার্জ (পুলিশ পরিদর্শক) জালাল উদ্দীন (২ বছর), ছিলিমপুর মেডিকেল ফাঁড়িতে ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন ইন্সপেক্টর মিলাদুন্নবী (বর্তমানে সোনাতলা থানার ওসি)। ৫ আগস্ট বগুড়া সদর থানায় কর্মরত ছিলেন এসআই বেদার উদ্দীন (বর্তমানে নন্দীগ্রাম থানায় কর্মরত)।
বগুড়া সদরের বর্তমান ওসি এসএম মইনুদ্দিন ২০২৪ সালের ১ জুলাই তৎকালীন রাজশাহীর বাগমারার এমপি আবুল কালাম আজাদের ডিও লেটার নিয়ে বগুড়া সদর থানায় যোগদান করে। তিনি এখনো ফ্যাসিস্টের পারপাস সার্ভ করছেন বলে তার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করা হয়েছে।
অপরদিকে সদর ফাঁড়ির মাহমুদুন্নবী এখনো বগুড়ায় রয়েছেন। এছাড়া সদর থানার এএসআই নজরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ৫-৬ জন এবং ট্রাফিক বিভাগে ৭-৮ জন এবং বগুড়া পুলিশ লাইনস মিলে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ঘুরেফিরে রীতিমত বহাল তবিয়তেই বগুড়ায় আছেন।
এ ব্যাপারে বগুড়ার পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা আমার দেশকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই তারা বদলি হয়ে আসেন। পুলিশ সুপার হিসেবে শুধু পদায়ন করার দায়িত্ব আমার রয়েছে।