Image description

আমানতকারীদের অর্থ সংরক্ষণের অন্যতম নিরাপদ মাধ্যম ব্যাংক। তবে নানা অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, নামে বেনামে ঋণের মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ যখন লুটপাট হয় তখন চ্যালেঞ্জ ও সংকটে পড়ে ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে দেয়ার পর তা ঋণের নামে লোপাট করা হয়। সেই টাকা আবার পাচারও হয় বিদেশে। এ ছাড়া পতিত আওয়ামী লীগের শাসনামলে দিনদুপুরে ব্যাংক দখল করা ছিল প্রকাশ্য বিষয়। এতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও সমর্থন ছিল। ফলে ২০২৪ সাল জুড়ে ব্যাংকের ওপর আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা ও আস্থার সংকট ছিল আমানতকারীদের মধ্যে। 

এমন পরিস্থিতিতে ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে। শুরু হয় ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ। ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা উদ্‌?ঘাটন ও ডলারের সংকট স্থিতিশীল করা হয়। রিজার্ভের পতন থামানো হয়। ব্যাংক খাতে অবাধ লুটপাট বন্ধ করা হয়। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট কাটতে শুরু করেছে। 

তবে বিভিন্ন উদ্যোগের সুফল পাওয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সরকার ও গভর্নরের যে আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে, সেই তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে সংস্কার প্রক্রিয়ার গতি ধীর হয়ে পড়েছে। তবে নতুন বছর ব্যাংক খাতে আঁধার কেটে আলো আসবে এমনই প্রত্যাশা আমানতকারী ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের আর্থিক খাতে সুশাসন ছিল অনুপস্থিত। ভেঙে পড়ে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা, ঋণের নামে লুটপাট করা হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। সরকার পতনের পর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়মের চিত্র। এ ছাড়া বছর জুড়ে দেশে ডলার সংকট ও তারল্য সংকট ছিল তীব্র। খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় রেকর্ড। রিজার্ভ কমে যায়। 

ব্যাংকাররা বলেন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে কিছু ব্যবসায়ী নামে-বেনামে শেয়ার ধারণ করে বেশ কয়েকটি ভালো ব্যাংকের মালিকানা দখল করে নেয়। এরপর সেসব ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণের নামে অর্থ লুটপাট করে নেয়। এতদিন বিষয়গুলো চাপা থাকলেও ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ধীরে ধীরে সেগুলো সামনে আসে। ব্যাংক খাতে অর্থ লুটপাটসহ নানা অনিয়ম খতিয়ে প্রকৃত চিত্র বের করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক খাতের সংস্কারে গঠন করা হয়েছে টাস্কফোর্স। এ ছাড়া তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংক থেকে অর্থের জোগান দেয়া হয়েছে। ফলে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে সংকট কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। 

এদিকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে। রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংক ঋণ এ খাতের সংকট তীব্র করেছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের সমস্যাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বীকৃত খেলাপি ঋণ ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ ২ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণ অবলোপন হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকার।

ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন: ৫ই আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অনেক ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে আমানতকারীদের চাহিদা অনুযায়ী আমানত ফিরিয়ে দিতে পারছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ড. আহসান এইচ মনসুরকে নতুন গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দেন। একই সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টার হয়ে তারল্য সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাতে দিন দিন তারল্য সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে ব্যাংকগুলো। 

টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা: প্রথমে সবল ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে গ্যারান্টার রেখে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয়া হয়। তাতে সংকট না কাটায় শেষ পর্যন্ত টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে। সংকটে থাকা ন্যাশনাল, এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংককে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে। 

ব্যাংক খাতে টাস্কফোর্স: আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করবে এই টাস্কফোর্স। এ ছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে ব্যাংক খাতের টাস্কফোর্স। 

রেমিট্যান্স প্রবাহ: আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে রেমিট্যান্সে বড় ধরনের ভাটা পড়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সেই রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাপক গতি পায়। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, চলতি অর্থবছর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে ১ হাজার ১১৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। জুলাইয়ে রেমিট্যান্স ২০০ কোটি টাকার নিচে এলেও আগস্ট থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৮৭৯ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ডিসেম্বর মাসের ২১ দিনে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে ২০০ কোটি ডলারের বেশি।

ডলারের দাম: ২০২৪ সালের শুরুতে ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের অস্থিরতা ছিল। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেয়ার পর ডলারের বিনিময় বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়, তাতে ডলার বিনিময় স্থিতিশীলতা দেখা যায়। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাজারে সংকট কাটাতে ডলার বিক্রি করেও জোগান দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবুও ২০২৩ সালে ডলারের দাম বেড়ে আন্তঃব্যাংক ১১১ টাকা এবং খোলাবাজারে ১২৫-১২৬ টাকা বেচাকেনা হয়ে রেকর্ড গড়েছিল। সর্বশেষ জুলাইয়ে ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৮ টাকা। ডলারের জোগান দিতে গিয়ে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। 

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে দর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন রিজার্ভ তলানিতে নেমে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমেছে। ২২শে ডিসেম্বর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪.৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের বিপিএম হিসাব অনুযায়ী তা ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। 

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ: অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তিন শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এসব হিসাব জব্দ করে। তাদের হিসাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা পাওয়া গেছে। জব্দ করা হিসাবে লেনদেনের তথ্য গড়মিল পাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্ত রিপোর্ট সিআইডি এবং দুদকে পাঠানো হয়েছে।

খেলাপি ঋণ: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা খেলাপিতে পরিণত করেছে নামধারী ব্যবসায়ীরা ও কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ। বার বার নিয়ম পরিবর্তন করে খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখানো হতো। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র বেরিয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬.৯৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা।

গভর্নরকে বয়কট: আর্থিক খাতের বিরল ঘটনা: বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ প্রকাশে বাধার প্রতিবাদে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের বক্তব্য বয়কট করেছিলেন সাংবাদিকরা। যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য বিরল ঘটনা। 

ব্যাংক একীভূত: ব্যাংক খাতে গতি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের এপ্রিলে ব্যাংক একীভূতকরণ সংক্রান্ত নীতমালা জারি করা হয়। এরই অংশ হিসেবে চারটি ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইও হয়। তবে সিদ্ধান্তহীনতায় খোদ দুর্বল ও সবল প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা।

গভর্নরের পলায়ন: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনদিন দায়িত্বে থাকলেও অফিস করেননি আব্দুর রউফ তালুকদার। শুরু হয় গুঞ্জন, বলা হয় তিনি পালিয়েছেন। এর চতুর্থ দিন ৯ই আগস্ট দুপুরে অনলাইনে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর। 

আলোচনায় ন্যাশনাল ও ইসলামী ব্যাংক: ঋণ জালিয়াতি ও নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংক বছর জুড়ে আলোচনায় ছিল। সিকদার গ্রুপমুক্ত হয়ে ব্যাংকটির দখল চলে যায় এস আলম গ্রুপের হাতে। এরপর গত ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু। তার বেশ কিছু উদ্যোগে নতুন করে ঋণ আদায় শুরু হয়েছে। একইভাবে ইসলামী ব্যাংককে এস আলমের দখলমুক্ত করা হয়। বিএনপি’র এক নেতা প্রকাশ্যে গুলি করে এস আলমের দখলে রাখতে ব্যর্থ হয়। দায়িত্ব ফিরে পান সাবেক কর্মকর্তারা। ধুঁকতে থাকা ব্যাংকটির নতুন বোর্ড আবারো চাঙ্গা করে তুলেছে এ ব্যাংকটিকে।

দায়িত্ব পাওয়ার পর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ বলেন, আর্থিক খাতের অনিয়মকারীদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। লুটেরাদের আইনের আওতায় এনে অর্থ পাচারকারীদের খুঁজে বের করা হবে।