চলতি বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। এ বছর সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়, প্রধান বিচারপতিসহ ৬ বিচারপতির পদত্যাগ ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সুপ্রিমকোর্টের বৈধতা নিয়ে সরব ছিলেন সুপ্রিমকোর্ট। এছাড়া, পঞ্চদশ সংশোধনীর দুটি ধারা অবৈধ ঘোষণা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সব আসামি খালাস ও ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের ঘটনা ছিল আলোচনায়। ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা নিয়ে রায়, হাইকোর্টের ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা ও খালেদা জিয়া-তারেক রহমানকে বিভিন্ন মামলা থেকে অব্যাহতির ঘটনাও ঘটে এ বছর।
এদিকে নতুন প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারের যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন তা জনগণকে আশাবাদী করে তুলেছে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বহাল করে উচ্চ আদালতের রায় থেকেই জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সূত্রপাত। রায় প্রত্যাখ্যান করে কোটা পদ্ধতি বাতিল চেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন নানা কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এর রেশ সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। রাজনৈতিক অঙ্গনের মতোই সুপ্রিমকোর্ট ছিল সরগরম। দেশের সব ক্রান্তিলগ্নে বারবরই সুপ্রিমকোর্ট ঐতিহাসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তবে কেউ কেউ সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকার সমালোচনাও করেছেন। তারা মনে করেন, বিচার বিভাগ নিয়ে জনগণের প্রত্যাশার জায়গা এখনও পূরণ হয়নি। মিথ্যা মামলায় হয়রানি এখনও চলছে, বন্ধ রয়েছে আগাম জামিন।
হাইকোর্টে কোটা পদ্ধতি বহাল
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। ফলে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি বহাল হয়। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে, যা আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে।
আন্দোলন করে কি রায় পরিবর্তন করা যায়, প্রশ্ন আপিল বিভাগের : ৪ জুলাই অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আপিল বিভাগ বলেন, রাস্তায় এত কিসের আন্দোলন শুরু হয়েছে? আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায়, সুপ্রিমকোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন? প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বৈধতার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত আবেদনের শুনানিকালে আপিল বিভাগ এ মন্তব্য করেন।
কোটা বহালে হাইকোর্টের রায় বাতিল, মেধায় চাকরি ৯৩ শতাংশ : ২২ জুলাই আপিল বিভাগ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন। একই সঙ্গে সাধারণ তথা মেধাবীদের জন্য ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনিদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। ওইদিন পৃথক দুটি লিভ টু আপিলের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেন।
আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করলেন প্রধান বিচারপতিসহ ৬ বিচারপতি : ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। দুপুর দেড়টার দিকে জানা যায়, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। এরপর দুপুর ২টার দিকে আন্দোলনকারীরা হাইকোর্ট এলাকা ছেড়ে চলে যান। বিকালে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগপত্র জমা দেন। তারা আইন মন্ত্রণালয়ে এ পদত্যাগপত্র জমা দেন বলে জানান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য পাঁচ বিচারপতি হলেন এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ
২০ অক্টোবর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন নিষ্পত্তি করে আদেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে। রায়ে সংবিধানের এ-সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ পুরোটাই পুনর্বহাল করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই সিদ্ধান্ত দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির বিধান বাতিল
এ বছরের ১৭ ডিসেম্বর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের দুটি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং আইনের আরও চারটি ধারা বাতিল করেন আদালত।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও উপদেষ্টাদের শপথ নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের মতামত
সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপিল বিভাগের মতামত চাইতে পারেন। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করানো যেতে পারে বলে মতামত দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ বিষয়টির ওপর মতামত দেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এই মতামত চেয়েছিলেন।