Image description

মধ্যরাত পর্যন্ত নাটকীয়তা এবং পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক টানাপোড়েনে ‘জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ থেকে পিছিয়ে এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্তর্বর্তী সরকারই জাতীয় ঐকমত্যে ঘোষণাপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘোষণাপত্র দিতে না পারলেও আজ মঙ্গলবার বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ নামে জমায়েত হবে। দেওয়া হবে ঘোষণাপত্রের প্রস্তাবনা।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐকমত্যে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোকে নিয়ে এ ঘোষণা দেওয়া হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির সূত্রগুলো সমকালকে জানিয়েছে, বিএনপির চাপেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাই শহীদ মিনার থেকে ঘোষণাপত্র পাঠ সমর্থন করেনি।
শেখ হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের সূত্রপাত করা ছাত্রনেতৃত্ব শহীদ মিনারে লাখো মানুষের সমাগম ঘটিয়ে রাজনৈতিক শক্তিও দেখাতে চেয়েছিল। সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্য একটি দলের এতে ইন্ধন রয়েছে সন্দেহে এ চেষ্টাকে ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। ফলে সরকার এবং অন্যরাও সমাবেশে সহযোগিতা করা থেকে পিছিয়ে যায়। পরে ছাত্রনেতৃত্বের মুখ রক্ষায় ‘সমঝোতা’র অংশ হিসেবে সরকারই ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়। 

সরকারের এ উদ্যোগে স্বস্তি জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল রাতে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিও বৈঠকে বসে। দলটির আশঙ্কা ছিল, অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সংবিধান স্থগিত বা বাতিলের চাপ তৈরি করা হতে পারে। বিএনপি বিদ্যমান সংবিধান বহাল রেখে দ্রুত নির্বাচন চায়। 

গতকাল সোমবার রাত পৌনে ১টার দিকে রাজধানীর বাংলমটরে সংগঠনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ জানান, ঘোষণাপত্র প্রকাশ না হলেও জমায়েত হবে। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কারণে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা যাচ্ছে না। কফিনে শেষ পেরেক মেরেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে মঙ্গলবার ছাত্র-জনতার জমায়েত হবে শহীদ মিনারে।

এর আগে রাত ৯টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হবে। 

গত শনিবার ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে ৩১ ডিসেম্বর (আজ) শহীদ মিনার থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করা হবে বলে জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। পরদিন শফিকুল আলম বলেছিলেন,  ছাত্রদের এ উদ্যোগে সরকারের সম্পৃক্ততা নেই। একে বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবেই দেখতে চায় সরকার।

মঙ্গলবারের ঘোষণা ঘিরে দেশব্যাপী নানা আলোচনা ও উত্তেজনার মাঝেই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শফিকুল আলম বলেন, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সব শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে। আমরা আশা করছি, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত এবং জাতির সামনে উপস্থাপন করা হবে।

দিনভর নানা নাটকীয়তা 
সরকারের এ সিদ্ধান্তের পর সমাবেশ হবে কিনা– তা নিয়েই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। চার ঘণ্টায় দফায় দফায় বৈঠকের পর আবদুল হান্নান বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে ঘোষণাপত্র দিতে রাষ্ট্রকে বলেছিলাম সহায়তা দিতে। সব রাজনৈতিক দলের কাছে গিয়েছি। বলেছি, যেন প্রত্যেকে এটা গ্রহণ করে। কারণ ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহাসিক দলিল হবে। কিন্তু এই ঐতিহাসিক দলিল যেন আমরা প্রস্তাব করতে না পারি, সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, তবে আমরা প্রাথমিকভাবে বিজয় লাভ করেছি। সরকার  ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা অবশ্যই আমরা শহীদ মিনার একত্রিত হবো। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্র আসবে– তাই বলে আমাদের একত্রিত হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে না। সমাবেশ সফলে সোমবার দিনভর একই ভবনে নাগরিক কমিটির কার্যালয়ও ছিল সরব। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা হিসাব করছিলেন, কোন জেলা থেকে কত বাসে কত মানুষ আসবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ঘোষণার পর সংগঠন দুটির নেতারা বৈঠকে বসেন। রাত পৌনে ১১টার দিকে বেরিয়ে যান নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। কিছুক্ষণ পর বিমর্ষ মুখে যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষারও বের হয়ে যান। তবে কেউ কথা বলেননি। সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সোয়া ১১টার দিকে চলে যান। 

কার্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন এলাকার সমন্বয়কারীরা ফোনে কথা বলছিলেন। একজনকে ফোনে বলতে শোনা যায়, বাসে করে সবাই রওনা হয়েছিল। এখন বাস থামিয়ে বসে আছে। এখনও কিছু চূড়ান্ত করছে না।

রাত ১২টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ কয়েকজন নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে আসেন। তখন সিদ্ধান্ত হয়, ঘোষণাপত্র প্রকাশ হবে না। তবে বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন যেহেতু রওনা হয়েছেন, তাই শহীদ মিনারে সমাবেশ হবে।

রাত দেড়টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার পুরো বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ জায়গায় এনেছে। একে সাধুবাদ জানাই। 

শক্তি দেখাতে চেয়েছিল ছাত্রনেতৃত্ব
শেখ হাসিনার পতন ঘটানো ছাত্রনেতৃত্ব নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন।  ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে মাঠের শক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা। পরিকল্পনা ছিল রাজনৈতিক দল গঠনের বার্তা এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণার।

ঘোষণাপত্র ও সমাবেশ নিয়ে কৌতূহল এবং আলোচনা ছিল। ছাত্রনেতারা সংবাদ সম্মেলনে এসে রোববার বলেছিলেন, ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের কবর রচিত হবে। নাৎসিবাদী আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করা হবে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে সমাবেশ ডাকা হলেও আয়োজনে ছিল নাগরিক কমিটি। সংগঠনটির নেতারা জানিয়েছেন, সারাদেশ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ জমায়েতের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছিল। সরকারের তিন উপদেষ্টাসহ গত ৩ আগস্ট ঘোষিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫৮ সমন্বয়ক, সহ-সমন্বয়করা থাকবেন।

জাতীয় নাগরিক কমিটির নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য সমকালকে বলেছেন, এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হবে– অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতা এখনও সক্রিয় এবং ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। আগামীতেও তা থাকবে।

সমাবেশ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহীদ মিনার এলাকায় আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি ও আলপনা। সমাবেশ উপলক্ষে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) হেডকোয়ার্টারে পুলিশ কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেন ছাত্রনেতারা। বিপুল জনসমাগম হবে ধরে ডিএমপি ট্রাফিক নির্দেশনা জারিও  করেছিল। 

ঢাকায় আসছেন ছাত্র
অনিশ্চয়তা থাকলেও অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা গতকালই ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেট জেলার আহ্বায়ক আকতার হোসেন সমকালকে জানান, জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন কলেজের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী ঢাকায় যাচ্ছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক সাজিদুল ইসলাম বাপ্পী জানান, ৩০টি বাসে খুলনা থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ ছাত্র-জনতা ঢাকায় যাবেন। বাস মালিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কম ভাড়া নিচ্ছেন। সেই টাকাও কেন্দ্র থেকে সমন্বয় করা হচ্ছে। দুপুরে খাবার খরচ প্রত্যেকে বহন করবেন।

জেলা জাতীয় নাগরিক কমিটির  সংগঠক অ্যাডভোকেট এজাজ আল ওয়াজি জিম ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সাকিব খান জানান, বগুড়া থেকে এক হাজার ২০০ জন ঢাকায় যাবেন। সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অভ্যুত্থানকারীদের ঢাকায় যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।