
সাভারের বিরুলিয়ার খাগানসহ বিভিন্ন এলাকায় সবুর খান দখল করেছেন কমপক্ষে ৪০ বিঘা জমি। বিরোধপূর্ণ দখলি জমিতে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণসহ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্থাপনার নামে একের পর এক সরকারি খাসজমি, খাল, বন বিভাগের জমিসহ সাধারণ োনুষের জমি দখলের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে তাঁর বিরুদ্ধে। প্রতিনিয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বাড়ানোর নামে গাছপালা ও টিলা কেটে সমান করার পাশাপাশি সরকারি খাল ভরাট করছে প্রতিষ্ঠানটি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাদের হাতে রেখে বেপরোয়া দখল বাণিজ্য চালিয়েছেন সবুর খান।
সাভারের খাগান ছাড়াও দত্তপাড়া ও চানগাঁও এলাকার জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ এখন ভুক্তভোগীদের মুখে মুখে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ড্যাফোডিলসের মালিক সবুর খান সরকারি কোর্ট অব ওয়ার্ড থেকে শুরু করে সরকারি খাস খতিয়ানের জমি—সবই গিলে খাচ্ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দোহাই দিয়ে সাধারণ োনুষের জমি জোরপূর্বক দখল করে নিচ্ছেন। কেউ জমি দিতে না চাইলে তাঁর জমির চারদিক থেকে ঘেরাও করে জিম্মি করে ফেলে তাঁর ক্যাডাররা।
পরে জমির বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম টাকায় জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আড়ালে অবৈধ জমির ওপরই গড়ে তুলছেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন স্থাপনা। এসব ঘটনায় জমি উদ্ধারের জন্য ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হলেও থেমে থাকেনি দখল বাণিজ্য। সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের খাগান, দত্তপাড়া, ও চানগাঁও মৌজায় বন বিভাগের জমিসহ খাল ও খাসজমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
আশুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বেলায়েত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি আমার জমি নিয়েছে ১০ বিঘা, আমার ভাইয়ের জমি আছে এবং আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের জমিও আছে। এসব জমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চারদিক দিয়ে ঘেরাও করে রাখায় আমরা সেখানে যেতে পারি না। আমাদের োঝেমধ্যে কিছু টাকা দিলেও অন্যদের কাউকে টাকা দেয় না তারা।’ এ ছাড়া রাস্তা আটকে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি জমিটি দখলের পাঁয়তারা করছে বলেও জানান তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই জমি দখল বাণিজ্য। বিরুলিয়া ইউনিয়নের দত্তপাড়া মৌজায় যে জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই কোর্ট অব ওয়ার্ডের জমি। জমিটির চারপাশে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় স্বভাবতই প্রতিষ্ঠানটির দখলে ছিল এসব জমি। এক পর্যায়ে জমি নিয়ে কোর্ট অব ওয়ার্ডের সঙ্গে ওই আবাসন প্রতিষ্ঠানটির ঝামেলা হলে ঝোপ বুঝে কোপ মারেন সবুর খান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামে জমি নেওয়া হলে অনেক ঝামেলা এড়ানো যাবে—এমন ভাবনা থেকে কোর্ট অব ওয়ার্ড প্রশাসনের জমিতে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলায় উদ্যোগী হন তিনি। এ ছাড়া বিতর্কিত এসব জমিতেই স্থায়ী ক্যাম্পাসের নামে যেসব স্থাপনা গড়ে তুলেছে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ, তার কোনোটিরই অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট আবাসন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে সবুর খান প্রথমে সেখানে অল্প কিছু জমি কেনেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমির নামজারি করাতে গেলে কোর্ট অব ওয়ার্ডের জমির মালিকানা পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে ভূমি অফিস থেকে নামজারি আবেদন নামঞ্জুর করে দেওয়া হয়। এরপর বিষয়টি জানতে পেরে নিজেদের জমি রক্ষায় এগিয়ে আসে কোর্ট ওয়ার্ড প্রশাসন। জবরদখলকারী হিসেবে মামলা করা হয় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে।
মামলার বিষয়টি যাতে গণমাধ্যমে না আসে সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হাবিব কাজল নেপথ্যে থেকে ভূমিকা পালন করতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সাংবাদিক ম্যানেজ করার নামে মোটা অঙ্কের অর্থও হাতিয়ে নেন এই কাজল। অন্যদিকে বিতর্কিত জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রক্রিয়ায় বৈধতা দিতে শিক্ষার্থীদের পিকনিক, নবীনবরন, সমাবর্তন অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন মেলার নামে সরকারি কর্মকর্তা থেকে মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের নিমন্ত্রণ করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভূমি কর্মকর্তা বলেন, ‘স্থায়ী ক্যাম্পাসের নামে কেবল সরকারি জমি দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, আশপাশে থাকা অন্য খাসজমিগুলোও নিজেদের নামে বরাদ্দ দেওয়ারও আবদার করেছে তারা। সরকারি জমিতে প্রতিষ্ঠানটি একের পর এক অবৈধ স্থাপনা গড়ে যাচ্ছে, সেটি প্রশাসনের জানা। তবে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় ও জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না।’
স্থানীয় মানবাধিকারকর্মী নজরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা বাণিজ্যের জন্য সরকারি জমি কোনোভাবেই হাতিয়ে নেওয়া উচিত নয়। নৈতিক বিষয়টি উপেক্ষা করে সমাজের দুর্নীতিবাজরা সরকারি জমি দখল করে প্রথমে জনস্বার্থের কথা বলে জনগণের সহানুভূতি আদায় করে। পরে সেখানে বাণিজ্য ফেঁদে বসে।
বন বিভাগের জমি দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে সাভারের কালিয়াকৈর বন বিটের কর্মকর্তা মো. মহিদুর রহমান বলেন, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ কী পরিমাণ বনের জমি দখল করেছে সেটা কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে সরকারি জায়গা দখলের বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য যোগাযোগ করা হলে কোনো তথ্য না দিয়ে বরং নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে সাংবাদিকদের প্রতিহত করেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক আনোয়ার হাবিব কাজল। এর সঙ্গে কাজলের ‘খাম বাণিজ্য’ও চলছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ডেকে তাঁদের যাতায়াত খরচ দেওয়ার কথা বলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ তুলে তা নিজেই লোপাট করেন বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় রাজধানীর ফার্মগেটে ছোট একটি দোকানে কম্পিউটারের পার্টস বিক্রি করতেন সবুর খান। এক পর্যায়ে অলাভজনক সেবামূলক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পান। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া টিউশন ফির অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ব্যয় না করে সেই অর্থ নানা কৌশলে অন্যত্র স্থানান্তর-বিনিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বজনদের নিয়োগ, সরকারি জমি দখল, কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার করে বাড়ি-ব্যবসা করেন সবুর খান। আর এসব করতে গিয়ে তিনি নানা সময় নিয়েছেন নানা কৌশল, প্রতারণার আশ্রয়। এ বিষয়ে জানতে সবুর খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।