Image description

Aman Abdullah( আমান আবদুল্লাহ )

 
সকালে অনলাইনে ঢুকে প্রথমেই দেখলাম উযিরে খামাখা মাহফুজকে হত্যার প্রচেষ্টা হয়েছে। মনটা একটু শংকিত হলো।
 
বাংলাদেশে রহস্যজনক হত্যার বিচার হয় না। সবাই রাজনৈতিক ফায়দা লুটে। আসল অপরাধী ও পরিকল্পনাকারীরা আড়ালে থাকে এবং বেশি ফায়দা লুটে। সুতরাং এমন ঘটনা ঘটলে, পুরনো ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটতেছে।
 
তারপরও 'হত্যাচেষ্টা' থেকে বুঝা যাচ্ছে মারতে পারেনাই। আপাতত ছেলেটা বেঁচে গেলো। অন্তত একটা প্রাণ তো বাঁচলো। প্রাণ সবচেয়ে অমূল্য, কিন্তু বাংলাদেশে এরও কোন মূল্য নাই।
 
এক/দুইদিন আগে সাম্য নামের যে প্রাণটা শেষ হয়ে গেলো, তাকে নিয়েই সবাই ফায়দা লুটতেছে। এখন তো অন্তত মাহফুজ নামের প্রাণটা বেঁচে গেলো।
এমন অসংখ্য চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেয়ে গেলো এক মূহুর্তের মধ্যে। তাড়াতাড়ি বিস্তারিত খবর খুঁজতে চেষ্টা করলাম।
একটু বিস্তারিত জানার পর হাসি পেয়ে গেলো।
 
হ্যা, বাংলাদেশে পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই ঘটতেছে। তবে ভাগ্য ভালো এটা কোন হত্যার বা হত্যার চেষ্টার পুনরাবৃত্তি হয়নাই। এটা হয়েছে শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টার নাটকের পুনরাবৃত্তি।
খামাখা মাহফুজ তার খামাখা দায়িত্বের অংশ হিসেবে খামাখাই রাস্তায় এসে পোলাপানের সামনে বাহাদুরি ফটকাচ্ছিলো। তখন কোন একটা পোলা তার উপর মিনারেল ওয়াটারের বোতল ছুড়ে মেরেছে।
এখানে হাসিনা থাকলে যা করতো, মাহফুজ ঠিক তাই করতেছে।
 
পার্থক্য হলো হাসিনার নিরংকুশ ক্ষমতা ছিলো, সে ফাটিয়ে ফেলতো। মাহফুজের ঐ ক্ষমতা নাই, তবে ক্ষমতার লোভ পুরোপুরিই আছে, সুতরাং সে সামর্থ্য অনুযায়ী কুঁদে যাচ্ছে।
ঘটনা জানার পর এবার সকালের নাস্তা খেতে খেতে বাংলা-দের নাটক দেখায় মনোনিবেশ করলাম।
 
এক শ্রদ্ধেয় বাংলা ভাই লিখেছেন, খামাখার উপর "টার্গেটেড হামলা হয়েছে। সরাসরি মাথায় এরকম হামলা ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন।"
মানুষ দেশ-দুনিয়া দেখলেও, অনেক বড় বড় সার্টিফিকেট নিলেও এবং অনেক জ্ঞান কপচালেও আসলে একদম গোড়ায় যে বাংলা থেকে যায়, তা আবারও দেখলাম। নতুন কিছু না।
তারপর দেখলাম বাংলারা নানা আবেগমথিত বিশ্লেষণে ফেটে পড়ছে।
 
খামাখা মাহফুজে না কি জাতির মুক্তির দিশারী। তার উপর এহেন আক্রমণ অত্যন্ত লজ্জাজনক।
এইসব বর্ণনা পড়ে অবশ্য একটা জিনিস ভালো লাগলো। বহুদিন বহুবছর যাবত আমি বাংলাদের একজন উপযুক্ত জাতির পিতা খুঁজে যাচ্ছি। কতজনকে ক্যান্ডিডেট বানালাম, কিন্ত এখনো কেউ টেকসই হয়নাই। মাহফুজ হয়তো হবে। এভাবে চালালে এবং লেগে থাকতে পারলে, তাহলে ইনশাআল্লাহ এতোদিন পর হয়তো শেখ মুজিবের অভাব পূরণ হতে পারে। ফইন্নিরা পুজা করার জন্য একটা ছোট্ট মুজিব খুঁজে পেয়েছে। তাদের জন্য শুভকামনা, এটা স্থায়ী হোক।
ভাই লিখেছেন "৭১ প্রশ্নটি আপসযোগ্য নয়- এমন সৎ উচ্চারণের কারণে মাহফুজ আলমের উপরে বর্বর ভাষায় আক্রমণ হয়েছে। তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রতীকী পশু বলি দেয়া হয়েছে। এমন জঘন্য কাজের পরে আজ তার উপর টার্গেটেড হামলা হয়েছে।"
 
কে বোতল ছুড়ে মেরেছে, কেন মেরেছে তা পরিস্কার না করে ঘটনার সাথে সাথে এরকম সুন্দর করে সুতা লাগিয়ে সুবিধামতো বক্তব্য দেয় মিথ্যাবাদী বাংলারা। মিছাখোর জাতির সবাই যার যার সুবিধামতো এইসব বক্তব্যের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। লাফাতে থাকে। কিন্তু সুন্দর করে বুঝিয়ে উপযুক্ত গালি দিলে তারাই আবার বলে হুজুরের মুখ খারাপ।
 
আমি সচেতনভাবে বাংলাদেশ এবং অন্য দেশের তুলনা কম করতে চেষ্টা করি। বরং এড়াতে চেষ্টা করি। তারপরও প্রায়শ হয়ে যায়। আজকে আবারও একটা তুলনা করবো।
রাজনীতিবিদদের উপর পানি, ক্রিমকেক, ডিম এইসব খাবার জিনিস নিক্ষেপ করার ঘটনা অস্ট্রেলিয়াতে প্রচুর দেখা যায়।
 
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে এক ডানপন্থী উগ্রবাদী একটা মসজিদে ঢুকে ৫১ জন মুসল্লিকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়ার ডানপন্থী কনজারভেটিভ সিনেটর ফ্রেজার এনিং মন্তব্য করে, মুসলমানদের অনিয়ন্ত্রিত ইমিগ্রেশনের ফলেই এ ঘটনা ঘটেছে। টিপিকাল বাংলাদেশী ভিকটিম ব্লেমিং এর মতো বক্তব্য।
 
ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে পরেরদিন। ১৬ মার্চ একটা দলীয় সমাবেশে সতেরো বছর বয়সী এক ছেলে, উইলিয়াম কনোলি গিয়ে সিনেটর ফ্রেজারের মাথায় একটা ডিম ফাটিয়ে দেয়।
"সরাসরি মাথায় এরকম হামলা ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন।" খিক খিকজ। ইংলিশে লিখতে হবে বাক্যটা, তাহলেই সত্য হয়ে যাবে।
ইনস্ট্যান্টলি ফ্রেজারের সমর্থকরা উইলিয়ামকে ভায়োলেন্টলি ট্যাকল করে। তাকে উপুড় করে ফেলে চেপে ধরে, তারপর পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তার আগে ফ্রেজার নিজে ছেলেটাকে থাপ্পড় দেয় এবং ঘুষি মারে। ডিম খেয়ে তার মাথা গরম হয়ে গেছিলো। প্রকৃতিগতভাবে সেও সম্ভবত খামাখা মাহফুজ টাইপের লোক ছিলো।
 
এই ঘটনার পর সিনেটর ফ্রেজারের বিরুদ্ধেও তদন্ত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সেলফ ডিফেন্সের যুক্তিতে তাকে কোন শাস্তি দেয়া হয় না।
ডিমবালক উইলিয়ামকে অফিশিয়ালি সতর্ক করা হয়। অন্য কোন শাস্তি না। ফ্রেজারের এক সমর্থক যে উইলিয়ামকে চেপে রাখা অবস্থায় কয়েকটা লাথি দিয়েছিলো তাকে এসল্ট চার্জে দোষী করা হয়।
ডিমবালককে আইনী সহায়তা করতে এবং "আরো ডিম কেনার খরচ জোগাতে" অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক স্বতস্ফুর্তভাবে গোফান্ডমিতে টাকা তুলতে শুরু করে। কিন্তু তাকে একটা ল ফার্ম বিনা পয়সায় সহায়তা দেয়। গোফান্ডমিতে ওঠা এক লাখ ডলার বা পচাত্তর লাখ বাংলাদেশী টাকা ডিমবালক নিজে না নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ মসজিদ ভিকটিমদের পরিবারের জন্য দিয়ে দেয়।
 
সেই রাজনীতিবিদ ফ্রেজার এনিং পরবর্তীতে নির্বাচনে হেরে রাজনীতি থেকেই বিদায় নিয়ে চলে গেছে।
এ ঘটনায় তখনকার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছিলো, ডিমবালককে যেভাবে ফ্রেজারের লোকজন এবং ফ্রেজার নিজে হেনস্থা করেছে, ডিসপ্রপোর্শনেলি, তার বিরুদ্ধে সরকার যথাযথ ব্যাবস্থা নেবে। নিয়েছিলো ও।
সেই প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকেই দুই মাস পর মে মাসের ৭ তারিখে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় এমবার হল্ট নামের ২৫ বছর বয়সী এক মেয়ে ডিম ছুড়ে মারে। কিন্তু এমবারের টার্গেট স্কিল উইলিয়ামের মতো ভালো ছিলো না। ডিমটা মরিসনের মাথায় না ফেটে চুলে ঘষা লেগে চলে যায়। এমবারকে পুলিশ ধরে ফেলে। বিচারের পর তাকে ১৫০ ঘন্টা সামাজিক কাজকর্ম করার শাস্তি দেয়া হয়।
 
"সরাসরি মাথায় এরকম হামলা ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন।" খিক খিকজ। প্রাইম মিনিস্টারকে এসাসিনেশন এটেম্পট। লোম সব খাড়িয়ে গেলো।
অসংখ্য ঘটনা এরকম। লিখতে থাকলে শেষ হবে না।
 
১৯১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী বিলি হিউ এর উপর ডিম মারা থেকে শুরু হয়েছিলো। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম ফ্রেজারের উপর এতো বেশি খাবার জিনিস মারা হয়েছিলো যে তার নাম হয়ে গিয়েছিলো 'প্রোজেকটাইল ম্যাগনেট' বা নিক্ষিপ্ত বস্তুর চুম্বক। পাবলিক তাকে নিয়মিত ডিম, টমেটো এসব ছুড়ে মারতো। এমন কি পার্লামেন্টের ভেতরে ভিজিটর গ্যালারি থেকে এই প্রধানমন্ত্রীর উপর এক মহিলা একটা ডিম মেরে দিয়েছিলো। মহিলা প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডও কয়েকবার ডিম, স্যান্ডউইচ এইসব মারা খেয়েছেন।
আমি বলতেছি না গিয়া ডিম মারেন। বোতল মারেন। আমি বলতেছি, কোদালকে কোদাল বলেন।
 
পানির বোতল মারা খেয়ে গান্ডু উপদেষ্টা বলেছে "একজন ব্যক্তির প্রতি গত আটমাস ধরে যে হিংস্রতা অনলাইনে দেখা যায় তারা এখানে সেটা দেখিয়েছে। আমি তাদের নাম উল্লেখ করবো না"।
নাম উল্লেখ করলে তো আর রাজনীতি থাকবে না। আবেগ নিয়ে থকথকে খেলা থাকবে না। এগুলোই হলো ধান্দার বন্দোবস্ত। যাকে বলা যায়, নব্য ধান্দোবস্ত।
যেইটা ক্ষোভের বহিপ্রকাশ, পানির বোতল ছুড়ে মারা, সেইটা হয়ে যায় হত্যাচেষ্টা।
 
এইসব ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা, একটা ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সবার বাল্লক হোমস হয়ে তদন্ত শুরু করে দেয়া এবং মনের মাধুরী মিশিয়ে জুহি চাওলা করা, এসবই বাংলাদেশের সংস্কৃতি। একদিন আগে সাম্য নামের যে ছেলেটা মারা গেলো, তাকে হত্যার ঘটনাতেও ঠিক একই কাজ করেছে এবং করতেছে সবাই।
 
সে বলেছে, "আজকে থেকে যমুনার সামনে আর কোনো অবস্থান করতে দেয়া হবে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।"
এই ক্ষুদ্র মানসিকতার ছেলেটা বারবার একটা জিনিস দেখিয়েছে। সে সবকিছুকে পার্সোনালি নেয়। বাংলাদেশে অনেক দুই নাম্বার রাজনীতিবিদ আছে, বরং বলা যায় সবাই দুই নাম্বার। কিন্তু তাদের অনেকে ছোটলোক না। এই ছেলেটা ছোটলোক ও বটে। শেখ মুজিবও এরকম ছিলো। লাল ঘোড়া দাবড়ে দেয়ার হুংকার দিতো।
 
রাজনীতি করতে আসছে, ক্ষমতার মধু খাবে পুরোটাই, কিন্তু পাবলিক ক্ষোভ দেখালে, ক্ষোভ দেখাতে গিয়ে এমন কি বাড়াবাড়ি করলেও, এইসব মালিকদের চেতনা দাঁড়িয়ে যায়। নব্য মালিক হয়ে উঠার জন্য এইসব চ্যাংড়া বন্দোবস্তের শুয়োররা তাদের সমস্ত কিছু বিনিয়োগ করেছে। পুরনো এবং পরীক্ষিত কৌশল। নব্য ধান্দোবস্ত।
 
তবে বাংলাদেশী এবং অস্ট্রেলিয়ানদের মাঝে পার্থক্য আছে।
বাংলাদেশীরা হলো কয়েক শত বছর ধরে গোলামীতে অভ্যস্ত গাদ্দারে ভরপুর জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ানরা হলো ভিনদেশ থেকে আসা কয়েক শত বছরের দখলদার হিংস্র কিন্তু কৌশলী জনগোষ্ঠী।
একদল মাটিতে সিজদা করে মালিকের পা চেটে অভ্যস্ত। অন্যদল মাথা উঁচু করে নিজের মালিকানা কায়েম করে অভ্যস্ত। কিন্তু সময় তো বদলাচ্ছে।
 
অস্ট্রেলিয়ানদেরকে চোখের সামনে বদলাইতে দেখতেছি। এই দেশে বসে বাদামী চামড়ার আমি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত অনেক কিছু করি যা এই পরিবর্তনের টেস্টামেন্ট। তারা আমাকে বলে, এই দেশকে নিজের করে নাও। অথচ জুলাই বিপ্লবে প্রাণ দেয়া রোহিঙ্গা ছেলেটার পরিবারকে পর্যন্ত বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয় না।
 
শুধু অস্ট্রেলিয়া না, আসলে পুরো দুনিয়াই বদলাচ্ছে। আমার শুধু একটাই আফসোস হয়, আমরা সম্ভবত বদলাবো না।