Image description

গ্যাস লিকেজ ও দুর্ঘটনা কমাতে নতুন করে ২ হাজার ৭৮১ কিলোমিটার গ্যাসলাইন স্থাপন করবে তিতাস। এজন্য ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পে ৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)। এনডিবির এ ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক হবে।

ঋণটি চীনা মুদ্রায় নিলে সুদহার কম পড়বে, তবে ডলারে নিলে সুদহার বেশি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিকল্পনা কমিশনে আগামী ২১ মে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হওয়ার কথা রয়েছে। কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

নতুন লাইন ব্যবস্থাপনার এ প্রকল্পটি নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন ৭৫ শতাংশ দেশীয় গ্যাস আছে, পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সালে ৭৫ শতাংশ এলএনজি হয়ে যাবে। এ পাইপলাইনে তিতাস কি এলএনজি সরবরাহ করবে, নাকি পানি সরবরাহ করবে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকার প্রকল্পটিতে সরকারের অর্থায়ন ৩ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা, তিতাসের নিজস্ব অর্থায়ন ৮২১ কোটি টাকা। বাকি অর্থায়ন এনডিবির ঋণ। বাংলাদেশে এনডিবির ঋণে এটি দ্বিতীয় প্রকল্প।

এর আগে ঢাকা পানি সরবরাহ প্রকল্পে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে ৩২ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করিয়েছে বাংলাদেশ। ওই প্রকল্পের মোট খরচ ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।

এর আগে ২০২৩ সালে এনডিবি বাংলাদেশের জন্য এক বিলিয়ন ডলার ঋণ বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিল। এনডিবি মূলত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট ব্রিকসের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া ব্যাংক। ব্যাংকটির যাত্রা শুরু হয় মূলত ২০১৪ সালে। শুরুতে ওই পাঁচ দেশই এনডিবির সদস্য ছিল। পরে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ এই ব্যাংকের সদস্য হয়।

তিতাসের প্রস্তাবিত প্রকল্পটির নাম ‘রিপ্লেসমেন্ট অ্যান্ড ইমপ্রুভমেন্ট অব দ্য এক্সিসটিং গ্যাস নেটওয়ার্ক ইন ঢাকা অ্যান্ড নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এরিয়া, ইনকরপোরেটিং জিআইএস ম্যাপিং অ্যান্ড স্ক্যাডা সিস্টেম’। প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার গ্যাসলাইনের জিআইএস নকশা করার পাশাপাশি ১৮টি গ্যাস স্টেশনে স্ক্যাডা সিস্টেম স্থাপন করবে সংস্থাটি।

প্রকল্পটির ঋণের সুদহার কত হবে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, এ ঋণের সুদহার হবে বাজারভিত্তিক। তবে কোন মুদ্রায় ঋণ অনুমোদন হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যদি চীনা মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হয়, তবে ঋণের সুদহার ২ দশমিক ৫ শতাংশ হবে আর যদি ডলারে নেওয়া হয়, তবে ৬ শতাংশের কাছাকাছি হবে। কিন্তু প্রকল্প চূড়ান্ত হলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

যে প্রকল্প প্রস্তাবটি (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে, এতে কিছু খাতে ব্যয় বেশি হয়েছে বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। ডিপিপিতে রোড রেস্টোরেশন খাতের ব্যয় ৩ হাজার ২১৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, এটি অত্যধিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাছাড়া এ প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০৮ কোটি টাকা, সেটিও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হয়েছে। ১৩ দশমিক ২৪ একর ভূমি কেনার জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১৮১ কোটি টাকা। প্রকল্পে জমি কেনার প্রয়োজন কীÑ সেটিও স্পষ্ট করা হয়নি ডিপিপিতে। পিইসি সভায় এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমার দেশকে বলেন, তিতাস গ্যাস কিনবে পেট্রোবাংলার কাছ থেকে। এখন ৭৫ শতাংশ দেশি গ্যাস আছে, পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সালে ৭৫ শতাংশ এলএনজি হয়ে যাবে। সেই এলএনজি আর এলপিজি গ্যাসের বাজার সম্প্রসারণের জন্য সরকার পলিসি নিয়ে পরিবহনে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। যেখানে ২০৩০ সালে এরকম গ্যাসের অবস্থা হবে, এখন ২০২৫ সালে এসে পাইপলাইনে তিতাস কি এলএনজি সরবরাহ করবে, নাকি পানি সরবরাহ করবে।

তিনি বলেন, এ টাকা খরচ করার পর তিতাস তখন পাইপলাইন ভাড়া আদায় করবে, এখন যেভাবে নিপীড়নমূলকভাবে মিটার ভাড়া আদায় করছে। এসব বিষয় ভোক্তা পর্যায়ে যে অনাস্থা তৈরি করেছে, তা অবিশ্বাসের জায়গা আরো মজবুত করবে। তারা এমনিতেই গণশত্রু হিসেবে বিবেচিত, এটা সে পথেই মানুষের অনাস্থাকে মজবুত করবে।

ডিপিপিতে প্রকল্পটির বাস্তবায়নের লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের গ্রাহকের জন্য গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা ২৭৫ এমএমসিএফডি থেকে বাড়িয়ে এক হাজার এমএমসিএফডি পর্যন্ত বাড়ানো হবে।

তাছাড়া ৫ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড সমতুল্য কার্বন নিঃসরণের ব্যবস্থা করে প্রতি মাসে গ্যাস লিকেজ দুর্ঘটনা কমিয়ে ৬৬টিতে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে প্রকল্পটিতে।

প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত স্ক্যাডা ও জিআইএস সিস্টেমের ব্যয়ের ভিত্তিও স্পষ্ট করা হয়নি। স্ক্যাডা সিস্টেমটি তিতাস ও অন্য সংস্থায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেখানে ফলাফল কি, তাও স্পষ্ট করা হয়নি ডিপিপিতে।

স্ক্যাডা হলো তত্ত্বাবধায়ক নিয়ন্ত্রণ এবং ডেটা অধিগ্রহণের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি একটি কন্ট্রোল সিস্টেম আর্কিটেকচার, এর মধ্যে রয়েছে কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক ডেটা কমিউনিকেশন এবং গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস মেশিন। আর জিআইএস বা ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে ভৌগোলিক উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করা হয়।

সাধারণত আইন অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ প্রস্তাব করা হয় সর্বোচ্চ ৩ বছর। কিন্তু এ প্রকল্পটির মেয়াদ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০৩০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত; অর্থাৎ ৫ বছর। পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে, এক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ নির্দেশিকাবহির্ভূত কাজ হয়েছে।

বর্তমানে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতিতে রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এক্ষেত্রে সরকারের যে ৩ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ের খাত ধরা হয়েছে, তা তিতাসের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হবে। সরকারের অর্থায়নের চাপ কমাতে এ পরামর্শ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা।