
একদিকে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে, অপরদিকে বাড়ছে বিদ্যমান ঋণ পরিশোধের চাপ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৫৮ শতাংশেরও বেশি। একই সময়ে ঋণ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছে। তবে এখনও কাঙ্ক্ষিত অর্থের খুব অল্প অংশই এসেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য একটি অশনি সংকেত তৈরি করছে।
একই সময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে খরচ হয়েছে ৩২১ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৮ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে এই খরচ ছিল ২৫৭ কোটি ডলার।
গভর্নর জানান, জুনের মধ্যেই আইএমএফ ১৩০ কোটি ডলার ছাড় করবে। এর সঙ্গে আগামী জুনের মধ্যে বাজেট সহায়তা হিসেবে আরও ২০০ কোটি ডলার আসবে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি), জাপান এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে।
উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তবতা
বিশ্বব্যাংক ও এডিবি এখনও বড় ঋণদাতা হিসেবে সক্রিয়। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি ছিল চলতি সময়ে বাংলাদেশের বড় দুই ঋণদাতা। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ৯৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, আর এডিবি দিয়েছে ৭০ কোটি ডলার।
সরকারের লক্ষ্য ১০ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা সংগ্রহের, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান থেকে ২২০ কোটি, বিশ্বব্যাংক থেকে ২৪৫ কোটি এবং এডিবি থেকে ১৭৯ কোটি ডলার পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। এছাড়া, প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের ‘পাইপলাইন’ ঋণ রয়েছে, যা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
ইআরডি বলছে, নতুন সরকার আসার পর প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে, যার কারণে ঋণচুক্তির হার কমে গেছে। তবে পরিস্থিতি শিগগিরই উন্নত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সহায়তার অনুরোধ
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি ও জাইকার কাছে আলাদাভাবে বাজেট সহায়তা ও প্রকল্প ঋণের অনুরোধ পাঠায়। এর মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয় আইএমএফের কাছ থেকে নতুন কুইক লোন হিসেবে, আর বাকি ২ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয় বিশ্বব্যাংক ও জাইকার বাজেট সহায়তা ও অবকাঠামো প্রকল্পে। তবে এখন পর্যন্ত কোনও সংস্থাই আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
অনিশ্চয়তার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরও এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি আসেনি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সরকারের অস্থায়ী মেয়াদ এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা এখন ‘অপেক্ষার’ নীতিতে রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতিতে সহায়তা পেতে হলে অর্থনৈতিক নীতির ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
কেন বাড়ছে না সহায়তা
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে মাত্র ৩০০ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৫৮.৫ শতাংশ কম।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘সরকার যেহেতু নতুন প্রকল্প নিচ্ছে না, তাই প্রকল্পভিত্তিক ঋণ কমেছে। বাজেট সহায়তার জন্য দাতা সংস্থাগুলোর কাছে এখনও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা হয়নি।’
অপরদিকে সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ‘বিগত সরকারের প্রকল্পে দুর্নীতি এবং বর্তমান সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—এই দুইয়ের কারণে নেগোসিয়েশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীরা এখন অনেক বেশি সতর্ক।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাতা সংস্থাগুলোর আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে।’
থমকে থাকা উন্নয়ন
চলমান আর্থিক সংকটের প্রভাব পড়ছে উন্নয়ন খাতেও। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নের হার গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ২৪.২৭ শতাংশ—মোট বরাদ্দ ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে খরচ হয়েছে মাত্র ৬৭ হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন সহায়তা না এলে বাজেট ঘাটতি পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এতে সামাজিক নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সেবা খাতে অর্থসংকট আরও তীব্র হতে পারে।