
রাজস্ব বাড়ানোর সরকারি পরিকল্পনার আওতায় আসন্ন অর্থবছরে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ছে বিলাসবহুল পণ্যে। এর অংশ হিসেবে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারকদের জন্য ভ্যাট দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন রাজস্ব বাড়াতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারকদের জন্য ভ্যাট বৃদ্ধি সরকারের রাজস্ব বাড়লেও চাপে পড়বেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। আগামী ২ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের জন্য অর্থ বিল ২০২৬ পেশ করার মাধ্যমে এমন প্রস্তাব আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বর্তমানে এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল হ্যান্ডসেটের স্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো একটি সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ আদেশের (এসআরও) অধীনে তাদের উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ পর্যায়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাসকৃত হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দেয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে বলে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে। বর্তমান চলতি এসআরওর মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। একই সাথে চলতি অর্থবছরও শেষ হবে।
এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, এনবিআর আগামী অর্থবছরের জন্য কর ছাড়ের মেয়াদ না বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এসি, মোবাইল সেট এবং রেফ্রিজারেটর প্রস্তুতকারকদের জন্য কর দ্বিগুণ বাড়বে। তিনি অনুমান করেছেন এসি এবং রেফ্রিজারেটর প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে ভ্যাট বাড়িয়ে প্রায় ২০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব। বর্তমানে যে হারে ভ্যাট আদায় করা হয় তাতে এ দু’টি গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদনকারী স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বছরে ১০০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে।
তথ্যে দেখা যায়, রাজস্ব বৃদ্ধির অংশ হিসেবে জানুয়ারিতে এনবিআর একটি বিজ্ঞপ্তিও জারির মাধ্যমে ঘোষণা করেছে রেফ্রিজারেটর, এসি এবং মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারকদের জন্য করপোরেট আয়কর হার ২০ শতাংশ হবে। এ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এনবিআর জানিয়েছে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারকদের ৩০ জুন, ২০৩২ পর্যন্ত সংশোধিত হারে কর দিতে হবে। এসি, রেফ্রিজারেটর এবং মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারকদের কর সুবিধা ২০০৯ সালের জুলাই মাসে দেয়া হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এটি ১২ বছরের জন্য ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে এই ছাড় ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিং ক্যাম্পেইনের আওতায় স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনের প্রচারণা বাড়াতে এই প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল।
ফেয়ার গ্রুপের এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইলেকট্রনিক্স বাজারে চাহিদার ৯০ শতাংশেরও বেশি পূরণ করে থাকে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে অনেক স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বাজার ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে গত কয়েক বছরে এনবিআর উৎপাদন খাতে উচ্চ হারে ভ্যাট আরোপ করায় প্রবৃদ্ধির গতি কমে এসেছে। বাজার গবেষণা দেখায় ভ্যাট ছাড় দেয়ায় চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক হার (সিএজিআর) বেড়েছে। যেখানে চরম আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এসি বাজার ১১ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক হার বেড়েছে। বাজেট পরিকল্পনায়, সরকার যদি আবার ভ্যাট বাড়ালে দামের উপর আনুপাতিক প্রভাব পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এনবিআরের এমন সিদ্ধান্তে বাজারে আরো নি¤œমুখী প্রবণতা দেখা দিতে পারে এবং স্থানীয় উৎপাদন বিনিয়োগ একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বলে সংশ্লিষ্টার মনে করছেন।
কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া, (ব্যবস্থাপনা অংশীদার স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি) বলেন, ফ্রিজ ও এসি শিল্প প্রায় দেড় দশক ধরে সরকারি সহায়তা পেয়েছে। এসব শিল্প এখন অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে সরকারকে এ ধরনের ট্যাক্স এক্সেম্পশন ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। একটা সময়ে বিলাসবহুল পণ্য হিসেবে বিবেচিত ফ্রিজ এখন সাধারণ গৃহস্থালি পণ্য হয়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ সুবিধা বাড়া, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সাশ্রয়ী মূল্যে দেশীয় পণ্যের উৎপাদনের কারণে এসব পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে।
তথ্যে দেখা যায় বর্তমানে দেশের ফ্রিজ বাজারের আকার ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি, বছরে প্রায় ৩৩ থেকে ৩৫ লাখ ইউনিট ফ্রিজ বিক্রি হয়। বাজারটি প্রতি বছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন, যমুনা ইলেকট্রনিক্স, ভিশন ইলেকট্রনিক্স (প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ) এবং সিঙ্গার বাংলাদেশ বাজারে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসি বিক্রি হয়েছে ৬ দশমিক ২ লাখ ইউনিট এবং এই বাজারের প্রত্যাশিত বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৪ শতাংশ।
দেশে ফ্রিজের বাজারে এককভাবে সবচেয়ে বড় অংশ ওয়ালটনের দখলে। ইলেকট্রো মার্ট দেশের শীর্ষ আরেকটি এসি প্রস্তুতকারক, যারা গ্রি ব্র্যান্ডের এসি বিপণন করছে। কোম্পানির একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বর্তমানে এক টনের গ্রি এসির দাম ৫৯ হাজার ২০০ টাকা। ভ্যাট বাড়লে প্রতি ইউনিটে ভোক্তাদের অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা গুনতে হবে। আশা করেছিলাম এই বছর বিক্রি বাড়বে; কিন্তু গরম তুলনামূলক কম হওয়া ও অর্থনীতির মন্থর গতির কারণে বিক্রি প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে। এসি এখন আর বিলাসপণ্য নয়, বরং প্রয়োজনীয় পণ্য হয়ে উঠেছে। ভ্যাট বৃদ্ধি যদি ধীরে ধীরে করা হতো, তাহলে ভোক্তাদের জন্যও মানিয়ে নেয়া সহজ হতো।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটা সময় পর্যন্ত ছাড় দেয়ার পর গত তিন বছর ধরে মোবাইল হ্যান্ডসেট নির্মাতাদের ওপর ভ্যাটের চাপ বাড়ছে। সম্প্রতি এনবিআর স্থানীয়ভাবে কমপক্ষে দু’টি কম্পোনেন্ট উৎপাদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ৫ শতাংশ এবং সম্পূর্ণ আমদানিকৃত উপকরণে তৈরি মোবাইলের ওপর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে। উভয় ক্ষেত্রেই এটি ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মোবাইল ফোন মার্কেটের প্রায় ৫০ শতাংশ আমদানি এবং চোরাই পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। ভ্যাট বাড়ালে আমদানি এবং চোরাই পণ্যের প্রবাহ বাড়বে। এতে বৈধ ও অবৈধ পণ্যের দামের পার্থক্য আরো বাড়বে এবং গ্রাহকরা অবৈধ পথে আসা মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। ভ্যাট বাড়ালে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হ্যান্ডসেট ভোক্তাকে বেশি দামে কিনতে হবে। অন্যদিকে আমদানি এবং চোরাই পণ্যের মার্কেট আরো বাড়বে। কেননা দামের পার্থক্যের কারণে ক্রেতারা চোরাই পথে আসা পণ্যের দিকে আরো বেশি আগ্রহী হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এক তথ্যে দেখা যায় ২০২৪ সালে প্রায় ৭৯ লাখ স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে। চলতি বছর ভ্যাট বৃদ্ধি ও অন্যান্য কারণে বিক্রি ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।