Image description
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধনী অধ্যাদেশ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ এর সংশোধনীর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল, অঙ্গ সংগঠন, আইনগত সত্তার বিচার করার আইনি অধিকার লাভ করলেও সম্ভব নয় শাস্তি প্রদান। সংশোধনীতে সংজ্ঞায়িত ‘রাজনৈতিক দল’, ‘অঙ্গ সংগঠন’ ও ‘আইনগত সত্তা’র ভুতাপেক্ষ কার্যকরিতা না থাকায় এমন আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বিচার বিভ্রাটেরও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এক সিনিয়র আইনজ্ঞ।

সংশোধন সংক্রান্ত অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯৭৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটির কার্যকরিতার তারিখ ছিলো ২০/০৭/১৯৭৩ খ্রি। আইনটি আমলে আসার আগে সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ ভূ-খ-ে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ইদ্যাতি অপরাধসমুহের বিচার ও শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন ও কার্যকর করা হয়। অতীতে মূল আইনে রাজনৈতিক সংগঠন বা দল এবং আইনগত সত্তার বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতে ১৯৭৩ সালের মূল আইনে সুযোগ ও বিধান ছিলো না। এ কারণে ২০১৩ সালে ৩ নম্বর আইন, যা অতীত তারিখ ১৪/০৭/২০০৯ খ্রি: প্রণয়ন ও কার্যকর হয়। ২০১৩ সালের ৩ নম্বর আইনে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা, ব্যখ্যা এবং আইনগত সত্তার সংজ্ঞা ও ব্যখ্যা ছিলো না। এ কারণে গত ১০ মে ২০ নম্বর অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও আইনগত সত্তার ব্যখ্যা ও সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২৫ সালের ২০ তম অধ্যাদেশটির কার্যকারিতা ও বলবতের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১০/০৫/২০২৫ খ্রি।

এ অধ্যাদেশের অধীনে রাজনৈতিক দল ও আইনগত সত্তা ইত্যাদির শাস্তির প্রদানের লক্ষ্যে ধারা ২০বি, অন্তর্ভুক্তি করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩’ সংশোধন করা হয়েছে। এ দুই ক্ষেত্রেই আইনের কার্যকারিতা ও বলবতের তারিখ ‘১০/০৫/২০২৫ খ্রি:’ উল্লেখ রয়েছে। ফলে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’র অধীন অপরাধ সমুহ শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে অতীত তারিখ (১৪/০৭/২০০৯ খ্রি:) এর স্থলে ১০/০৫/২০২৫ উল্লেখ করা সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অনুচ্ছেদ ৩৫(১) এ বলা হয়েছে, ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দ- দেয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দ- দেওয়া যাইবে না।’

সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের আলোকে ১৪/০৭/২০০৯ থেকে অতীত ও বকেয়া তারিখ দিয়ে ২০২৫ সালের ২০ নম্বর অধ্যাদেশ বলবত ও কার্যকর করা হলে সাংবিধানিকবাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এ সংশোধনীতে অভিযুক্ত সংগঠন ও আইনগত সত্তার বিচার করার আইনি এখতিয়ার সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু শাস্তি প্রদানের অধিকার মেলেনি।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, যদি সংশোধনীর সংশোধন আনয়ন করা না হয় তাহলে অভিযুক্তের শাস্তি প্রদান করা হবে অসাংবিধানিক ও সাংঘর্ষিক। এতে বিচার বিভ্রাট ও আইনি জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি বলেন, ২০২৫ সালের ২০ নম্বর অধ্যাদেশ যা, ১০/০৫/২০২৫ থেকে বলবত ও কার্যকর করা হয়েছে-মর্মে অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ১৪/০৭/২০০৯ থেকে বকেয়া ও অতীত তারিখ থেকে কার্যকর করা হয়নি। ফলে রাজনৈতি সংগঠন, অঙ্গ সংগঠন ও আইনগত সত্তার বিচার করার অধিকার সৃষ্টি হলেও শাস্তি দেয়ার অধিকার তৈরি হয়নি। এ অধিকার সৃষ্টি করতে হলে ১৪/০৭/২০০৯ খ্রি: থেকে ‘রাজনৈতিক সংগঠন’ ও ‘আইনগত সত্তা’ সংজ্ঞাটির (ভূতাপেক্ষ) কার্যকরিতা দিতে হবে। ওই সময় এ দু’টি বিষয়ের কোনো সংজ্ঞা ছিলো না। আইনগত সত্তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে গত ১০/০৫/২০২৫ ইং তারিখে। বর্তমান অধ্যাদেশটি ১৪/০৭/২০০৯ সাল থেকে কার্যকরিতা দিলে রাজনৈতিক সংগঠন ও আইনগত সত্তার শাস্তি দেয়া সম্ভব-মর্মে অভিমত দেন এই আইনজ্ঞ।
প্রসঙ্গত: গত ১০ মে রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (১৯৭৩) সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার।

গেজেটে বলা হয়, সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (দ্বিতীয় সংশোধনী) অর্ডিন্যান্স, ২০২৫ প্রণয়ন ও জারি করেছেন। সংশোধনীতে বলা হয়, সংগঠন অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দল, অথবা সেই দলের অধীনস্থ, সংশ্লিষ্ট বা সহযোগী কোনো সত্তা, অথবা এমন কোনো ব্যক্তি- গোষ্ঠিকে বোঝায় যা ট্রাইব্যুনালের অভিমত অনুযায়ী, ওই দল বা সত্তার কার্যকলাপ প্রচার, সমর্থন, অনুমোদন, সহায়তা বা সম্পৃক্ততার মাধ্যমে জড়িত থাকে; সংগঠনের জন্য শাস্তি ইত্যাদি। ‘এই আইনের বা তৎকালীন প্রযোজ্য অন্য কোনো আইনের যাই থাকুক না, যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কোনো সংগঠন এই আইনের ৩ ধারার উপ-ধারা (২) অনুযায়ী উল্লিখিত অপরাধসমূহ করেছে, নির্দেশ দিয়েছে, চেষ্টা করেছে, সহায়তা করেছে, প্ররোচিত করেছে, উসকানি দিয়েছে, ষড়যন্ত্র করেছে, সহজতর করেছে বা সহযোগিতা করেছে, তাহলে ট্রাইব্যুনাল সেই সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করার, সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার, তার নিবন্ধন বা লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করার এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখবে।

এর আগে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগকে বিচারের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনীতে অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।