Image description

বারবারই পাইলটদের লাইসেন্স দেওয়া সংক্রান্ত অনিয়ম উদঘাটন ও বিমান নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ। কিন্তু প্রতিবারই সেগুলো উপেক্ষিত হয়েছে সিভিল এভিয়েশনের উচ্চপর্যায়ে।

দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা নথি অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেবিচকের ইস্যুকৃত অন্তত ১৪৪টি পাইলট লাইসেন্সের সঙ্গে জড়িত গুরুতর অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। এর বেশ কয়েকটি ইস্যু করা হয়েছে গত দুই বছরের মধ্যে।

সেখান থেকে উঠছে দেশের উড়োজাহাজ চলাচলের মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (ICAO) বা ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর তীব্র নজরদারির মুখোমুখি হতে পারে বলে মনে করছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা।

বেবিচকের তদন্তে দেখা গেছে, গ্যালাক্সি ফ্লাইং অ্যাকাডেমি ও বাংলাদেশ ফ্লাইং অ্যাকাডেমি নামক দুটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম বড় অনিয়মের মধ্যে রয়েছে, বাধ্যতামূলক একক ফ্লাইট সম্পূর্ণ না করেই পাইলটদের লাইসেন্স সুপারিশ করা। 

একক ফ্লাইট পাইলট প্রশিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর উদ্দেশ্য হলো, প্রশিক্ষণার্থী যেন স্বতন্ত্রভাবে একটি উড়োজাহাজ পরিচালনা করতে এবং আকাশে যেকোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে সক্ষম হন, তা নিশ্চিত করা।

অন্যান্য অনিয়মের মধ্যে রয়েছে, একজন পাইলট নিজের লাইসেন্সে নিজেই সই করে নিজেকে অনুমোদন দিয়েছে; আরেকজন এমন উড়োজাহাজের 'চেক পাইলট' হয়েছেন, যেটা তিনি কখনোই চালাননি; কয়েকজন পাইলট লাইসেন্স পাওয়ার শর্ত পূরণের জন্য ভুয়া ফ্লাইট ঘণ্টা দেখিয়েছেন (বিস্তারিত আগামীকালের দ্বিতীয় পর্বে)।

সম্প্রতি এক পরিদর্শনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দেখতে পেয়েছে, পাইলটদের লিখিত পরীক্ষা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনুমোদনহীন সফটওয়্যার ব্যবহার করে নেওয়া হয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবহার করা অফিসিয়াল ঠিকানায় কোনো অফিসও খুঁজে পায়নি ডেইলি স্টার।

পাইলটদের জন্য তিন ধরনের লাইসেন্স রয়েছে—প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স (পিপিএল), কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স (সিপিএল) এবং এয়ারলাইন ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স (এটিপিএল)।

পিপিএল হলো প্রাথমিক ধাপ। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি উড়োজাহাজ ওড়ানোর অনুমতি পায়। আর পেশাদার পাইলট হতে হলে সিপিএল নিতে হয়। এটিপিএল পাইলটদের সর্বোচ্চ স্তরের সনদ। বিস্তৃত ফ্লাইট অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পর বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসের প্রধান পাইলট হওয়ার জন্য এই সনদ প্রয়োজন হয়।

যে ১৪৪ জন ব্যক্তি প্রশ্নবিদ্ধ পদ্ধতিতে লাইসেন্স পেয়েছেন, তাদের মধ্যে ১২০ জনের পিপিএল, ২২ জনের সিপিএল এবং দুইজনের এটিপিএল পেয়েছেন।

নির্ভরযোগ্য সংখ্যা পাওয়া না গেলেও তাদের মধ্যে কয়েকজন বর্তমানে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের বিভিন্ন পদে কর্মরত আছেন, এমনকি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসেও রয়েছেন।

নিয়ম উপেক্ষা

গ্যালাক্সি ফ্লাইং অ্যাকাডেমি এবং বাংলাদেশ ফ্লাইং অ্যাকাডেমি (বিএফএ) বাংলাদেশের দুটি জনপ্রিয় ফ্লাইং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। এই দুই প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর ডজনখানেক পাইলট তৈরি করে।

গত কয়েক বছরে এই দুটি প্রতিষ্ঠান ১৪২ শিক্ষার্থীর জন্য পাইলটিং লাইসেন্সের সুপারিশ করেছে—যদিও তারা পিপিএল ও সিপিএলের জন্য যথাক্রমে প্রয়োজনীয় ১৫০ নটিক্যাল মাইল (এনএম) একক ফ্লাইট এবং ৩০০ নটিক্যাল মাইল ক্রস-কান্ট্রি ফ্লাইট সম্পন্ন করেনি। এমনটাই উঠে এসেছে বেবিচকের তদন্তে।

বেবিচকের সিভিল এভিয়েশন রুলস ও এয়ার নেভিগেশন অর্ডার অনুযায়ী, পিপিএল পাওয়ার জন্য পাইলটদের পাঁচ ঘণ্টার একক ক্রস-কান্ট্রি ফ্লাইট সম্পন্ন করতে হয়, যার মধ্যে অন্তত একটি ফ্লাইটে ২৭০ কিলোমিটার (১৫০ এনএম) পথ অতিক্রম করে দুটি ভিন্ন বিমানবন্দরে অবতরণ করতে হয়।

যারা সিপিএল পেতে চান, তাদেরকে প্রধান পাইলট হিসেবে ৩০০ নটিক্যাল মাইল ফ্লাইট সম্পন্ন করতে হয়। বাণিজ্যিক পাইলট হিসেবে যোগ্যতা অর্জনের জন্য তাদের অন্তত ৫৪০ কিলোমিটার (৩০০ নটিক্যাল মাইল) পথ অতিক্রম করে দুটি ভিন্ন বিমানবন্দরে অবতরণ করতে হয়।

তবে বেবিচকের তদন্তে দেখা গেছে, গ্যালাক্সি ও বিএফএ থেকে পাস করা পাইলটরা নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করেননি এবং তাদের উড্ডয়ন ঘণ্টা, নীতিমালায় উল্লেখিত সময়ের তুলনায় অনেক কম ছিল। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, পাইলট হিসেবে তাদের দক্ষতা আদৌ পরীক্ষা করা হয়েছে কি না।

এই পরীক্ষার জন্য উভয় প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিমানবন্দরকে তাদের প্রশিক্ষণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।

গ্যালাক্সির পিপিএল লাইসেন্সপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা রাজশাহী-বগুড়া-সৈয়দপুর-রাজশাহী রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করেছিল।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বেবিচককে পাঠানো গ্যালাক্সির এক চিঠিতে দেখা যায়, অন্তত ১১০ জন শিক্ষার্থী ১৫০ নটিক্যাল মাইল একক ফ্লাইটে বগুড়া বা সৈয়দপুরে না থেমেই উড়ে গেছে। অথচ, দুটোতেই অবতরণ করা বাধ্যতামূলক।

এই অনিয়মের ব্যাখ্যায় গ্যালাক্সি বিমানচালনা কর্তৃপক্ষকে জানায়, ট্রানজিট বিমানবন্দরে অবতরণ না করার কারণ হলো—একবার উড়োজাহাজ বন্ধ করলে, পুনরায় চালু করতে একজন অনুমোদিত প্রকৌশলীর সইসহ রিলিজ ফর্ম প্রয়োজন। গ্যালাক্সি বলেছে, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলীর স্বল্পতা থাকায় আমরা এটা করতে পারি না।'

গ্যালাক্সি আরও জানায়, বগুড়া একটি নিয়ন্ত্রিত সামরিক এলাকা হওয়ায় সেখানে অবতরণের জন্য এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলারের সঙ্গে আগাম সমন্বয় করতে হয়। তাই তারা সেখানে অবতরণ করে না।

প্রকৃতপক্ষে, ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর গ্যালাক্সি বেবিচককে এক চিঠি দিয়ে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে এই অব্যাহতি চেয়েছিল, কিন্তু তাদের সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়।

বেবিচকের কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তাদেরকে এই সুযোগ দেওয়া হয়নি। কারণ, নির্দিষ্ট এই রুট ব্যবহারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের যেকোনো রুটে উড়তে এবং যেকোনো বিমানবন্দরে থামতে পারেন।

এ ছাড়া, গ্যালাক্সির সিপিএল প্রত্যাশী ১০ শিক্ষার্থীকে রাজশাহী-সৈয়দপুর-যশোর-রাজশাহী রুটে ৩০০ এনএম ফ্লাইট করতে এবং ট্রানজিট বিমানবন্দরগুলোতে পূর্ণ অবতরণ করতে বলা হয়েছিল।

কিন্তু শিক্ষার্থীরা তার পরিবর্তে রাজশাহী থেকে সৈয়দপুরে গিয়ে আবার রাজশাহীতে ফিরে আসে এবং একই পদ্ধতিতে যশোরেও ফ্লাইট পরিচালনা করে।

গ্যালাক্সির চিঠিতে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, 'ফ্লাইটের সম্পূর্ণ রুট কাভার করার মতো স্থায়ীত্ব না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রথম ধাপ শেষে ঘাঁটিতে ফিরে আসে জ্বালানি নেওয়ার জন্য।'

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর মানে শিক্ষার্থীরা সৈয়দপুর থেকে যশোর পর্যন্ত যে রুট, সেটি শেখেনি। তারা আরও বলেন, এক ব্যারেল জ্বালানি যশোর বা সৈয়দপুর বিমানবন্দরে পাঠানো গ্যালাক্সি একাডেমির জন্য খুব কঠিন কাজ ছিল না। বর্তমানে ৩০০ ডলারের কম দামে পাওয়া এক ব্যারেল দিয়ে শিক্ষার্থীদের চালানো সেসনা-১৫২ উড়োজাহাজটি দুইবার এবং সেসনা ১৭২ একবার পুনরায় জ্বালানি ভরার জন্য যথেষ্ট।

বাংলাদেশ ফ্লাইং অ্যাকাডেমিও (বিএফএ) একই পথে হেঁটেছে।

এর শিক্ষার্থীরাও রাজশাহী-বগুড়া-সৈয়দপুর-রাজশাহী রুটে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। গ্যালাক্সির মতোই মতোই তারা বগুড়া ও সৈয়দপুরে না থেমেই রাজশাহীতে ফিরে এসেছে।

২০২৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বেবিচককে পাঠানো চিঠিতে বিএফএ এই অনিয়মের ব্যাখ্যা দিয়ে বলে, 'বগুড়া একটি নিয়ন্ত্রিত বিমানবন্দর। তাই শিক্ষার্থীরা সেটার ওপর দিয়ে কেবল উড়ে গেছে।'

সব শিক্ষার্থীকে একক ফ্লাইট পরিচালনা করতে বলা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রশিক্ষকদের সহায়তা ছাড়াই তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করার কথা ছিল। কিন্তু তারা ঠিক এর বিপরীত কাজটি করেছে।

বেবিচককে দেওয়া ব্যাখ্যায় বিএফএ জানায়, 'সৈয়দপুরে বিমান একবার বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় চালু করার জন্য নথিতে একজন পাইলট বা প্রকৌশলীর সই করতে হয়। তাই একজন নিরাপত্তা পাইলট সঙ্গে ছিলেন।'

বেবিচকের এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বিএফএ চাইলে খুব সহজেই একজন পাইলট বা প্রকৌশলীকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে মাত্র ৬০ হাজার টাকা বেতনে নিয়োজিত করতে পারত, যাতে শিক্ষার্থীরা অবতরণ করলে তিনি নথি সই করে দিতে পারেন।

একই ঘটনা ঘটেছে সিপিএল লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় ৩০০ নটিক্যাল মাইল একক ফ্লাইটের ক্ষেত্রেও।

শিক্ষার্থীদের রাজশাহী-যশোর-সৈয়দপুর-রাজশাহী রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে এবং ট্রানজিট বিমানবন্দরে পূর্ণ অবতরণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা রাজশাহী থেকে যশোর গিয়ে রাজশাহীতে ফিরে আসে এবং পরে সৈয়দপুরে একটি রাউন্ড ট্রিপ করে বলে বেবিচককে জানিয়েছে বিএফএ।

চিঠিতে বলা হয়েছে, 'স্থায়ীত্বের অভাবে আমাদের রাজশাহীতে ফিরে পুনরায় জ্বালানি নিতে হয়েছে এবং দ্বিতীয় ধাপের ফ্লাইট আবার শুরু করতে হয়েছে।'

তবে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেন, একাডেমি চাইলে যশোর বা সৈয়দপুরে জ্বালানির ব্যারেল ও হ্যান্ডপাম্প ব্যবহার করে সহজেই পুনরায় জ্বালানি নিতে পারত।

নথি অনুযায়ী, ১৫০ নটিক্যাল মাইল 'একক ফ্লাইট' পরিচালনাকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও তাদের শিক্ষকরা ছিলেন। যদিও এই ফ্লাইটগুলো তত্ত্বাবধায়কদের ছাড়াই হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ, তারা পরীক্ষামূলক ফ্লাইটটিও শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে উড়িয়েছে।

বিএফএর চিঠিতে বলা হয়েছে, 'উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ স্থগিত হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি বা দুর্ঘটনা এড়াতে অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে কখনো কখনো একক ফ্লাইটে নিরাপত্তা পাইলট সঙ্গে রাখা হয়েছে...বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং ভবিষ্যতে এমনটি আর ঘটবে না।'

তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফ্লাইট পরিচালনা ও নির্ধারিত রুট অনুসরণ না করলেও বিএফএ থেকে পাস করার পর কমপক্ষে ২২ শিক্ষার্থীকে বেবিচক লাইসেন্স দিয়েছে, যাদের মধ্যে ১০ জন পিপিএল ও ১২ জন সিপিএল পেয়েছেন।

বেবিচকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের চিত্রে উঠে এসেছে, কীভাবে প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা বিভাগের সতর্কতা সত্ত্বেও এসব শিক্ষার্থীদের কয়েকজন লাইসেন্স পেয়েছেন সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে।

২০২৪ সালের ২১ মে বেবিচকের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ডস ও রেগুলেশন বিভাগ বিএফএ থেকে আসা ওই ২২ ক্যাডেট পাইলটের মধ্যে দুইজনের অভিজ্ঞতা কম থাকা সত্ত্বেও লাইসেন্স দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে তৎকালীন লাইসেন্সিং প্রধানের সঙ্গে এক বৈঠকের আয়োজন করে।

বৈঠকে উল্লেখ করা হয়, 'ফ্লাইট সময় সিপিএল দক্ষতা পরীক্ষার শর্ত পূরণের জন্য যথাযথ নয়।'

তবে সিএএবির নথি অনুযায়ী, পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে 'পূর্ববর্তী রীতি' এবং বিএফএ ও গ্যালাক্সির বর্ণিত 'অপরিহার্য পরিস্থিতি' বিবেচনায় প্রার্থীদের লাইসেন্স দেওয়া উচিত।

পরে উভয় পাইলটকে সিপিএল প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা পেশাদার পাইলট হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। এই দুই পাইলটের একজন বর্তমানে বিমানে সহকারী হিসেবে কর্মরত, অন্যজন বেকার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই দুই একাডেমির মধ্যে একটির কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, অন্যান্য বিমানবন্দরে প্রকৌশলী, পাইলট ও পুনরায় জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা বাবদ খরচ বহন করতে চায়নি বলেই তাদের প্রতিষ্ঠান এই অনিয়ম করেছে।

গ্যালাক্সি ফ্লাইং অ্যাকাডেমির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান ইমাম ফারাজী বলেন, 'আমরা সমস্যাটি সম্পর্কে অবগত। আপনাকে যে নিশ্চয়তা দিতে পারি সেটা হলো, শিগগির এর সমাধান হবে। যেহেতু এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তাই বিস্তারিত আর বলছি না।'

বিএফএ চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তমসহ তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে এবং হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে রাজি হননি।

তবে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এটি চলমান প্রক্রিয়া। আশা করি সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এর সমাধান করবে। তাই এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না।'

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যাডেট পাইলটরা ফ্লাইং স্কুল শেষ করে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে সংশ্লিষ্ট একাডেমি বেবিচকের কাছে তাদের পক্ষে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। এরপর বেবিচক শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা যাচাই করে লাইসেন্স প্রদান করে।

গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেবিচক কর্মকর্তা বলেন, 'যদি প্রশিক্ষণের শর্ত পূরণ না করেই শিক্ষার্থীদের লাইসেন্স দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে বেবিচক কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না।'

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া প্রশিক্ষণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, এটা নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ সৃষ্টি করে না।

তিনি বলেন, 'এটা আসলে কোনো নিরাপত্তাজনিত সমস্যা না। আমরা বিস্তারিত একটি তদন্ত করছি। এর মানে এই নয় যে তারা নিরাপদে উড়োজাহাজ উড়াতে পারেন না।'

এই পাইলটদের কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে সিএএবি আইনগতভাবে দায়ী হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'একজন পাইলট তার প্রাথমিক প্রশিক্ষণে তৃতীয় বিমানবন্দরে পূর্ণ অবতরণ করেনি বলে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন, এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়।'

২০২৪ সালের আগস্টে বেবিচক চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া মঞ্জুর আরও জানান, এমন কোনো কিছুর লঙ্ঘন হয়নি যা 'ঝুঁকিপূর্ণ উড্ডয়ন' হিসেবে গণ্য হবে এবং বেবিচক সবসময় ICAO-এর নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনে চলে।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে লিখিত জবাবে বলেন, 'ভুল ব্যাখ্যা, বিভ্রান্তিকর বা ভ্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হলে উদ্বেগের সৃষ্টি হবে। এখন পর্যন্ত আমরা কোনো "গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ" সৃষ্টি করার মতো কিছু খুঁজে পাইনি।'

কোনো দেশের সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা তদারকিতে বড় ধরনের ঘাটতি থাকলে ICAO তাদের গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ (এসএসসি) হিসেবে র‌্যাংক করে। বাংলাদেশ ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই অবস্থানে ছিল।

সন্দেহজনক সেবা

২০১৭ সাল থেকে এ৪এরো লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান পাইলট হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষা পরিচালনা করে আসছে। পরীক্ষাগুলো একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে নেওয়া হয়, যা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেবিচক পরীক্ষার ফলাফল পায়।

সফটওয়্যারটির পূর্ণ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ এ৪এরোর কাছেই রয়েছে। এমনকি পরীক্ষার সব তথ্যও সংরক্ষিত আছে তাদের ক্লাউড সার্ভারে। এর ফলে জালিয়াতি ও প্রতারণার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনটাই বলা হয়েছে সরকারি একটি সংস্থার প্রতিবেদনে।

২০২৫ সালের ১৭ মার্চ বেবিচক অফিস পরিদর্শনকারী দুদক তদন্তকারীরা দেখতে পান, এ৪এরোকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় বিধিমালা মানা হয়নি।

সরকার বেবিচককে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবকাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার মানে—বেবিচক যেকোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করলে সেটা অবশ্যই বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের কঠোর গুণগত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

নথিপত্রে আরও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে পরীক্ষার দায়িত্ব নেওয়া শুরু করে। যদিও তখন পর্যন্ত তারা নিবন্ধিতই ছিল না। ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধন পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৪ হাজার ৮৪টি পরীক্ষা নিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির মালিক ক্যাপ্টেন এস এম নাজমুল আনাম। তিনি বেবিচকের সাবেক ফ্লাইট সেফটি ডিরেক্টর।

গত সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি বেবিচকে কর্মরত ছিল। ২০০৯-২০১২ সময়কালে ICAO-র 'গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ'র মধ্যে থাকা বাংলাদেশ তার নেতৃত্বেই নিরাপত্তা উদ্বেগমুক্ত হয়।

তিনি বলেন, 'বেবিচকে লিখিত পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস নিয়ে সমস্যায় থাকায় আমাদের উৎসাহীত করে সফটওয়্যার বানাতে এবং ২০১৭ সালে আমরা সফটওয়্যারটি তৈরি করা শুরু করি। বেবিচকের সফটওয়্যারটি আনুষ্ঠানিকভাবে কেনার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। তারা শুধু ব্যবহার করছে।'

নাজমুল বর্তমানে ICAO-এর এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ফ্লাইট সেফটি রিজিওনাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ডেটা ও সফটওয়্যারের ওপর বেবিচকের নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ডেভেলপাররা কোম্পানি ছেড়ে চলে গেছে। আমার কাছে সোর্স কোড নেই। বেবিচকের কাছেও নেই। ডেটা আমার কোম্পানির ক্লাউড সার্ভারে আছে।'

এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার চার দিন পর গতকাল শনিবার সকালে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, তিনি সোর্স কোড খুঁজে পেয়েছেন এবং ডেটাবেসটি বেবিচকের কাছে হস্তান্তর করেছেন।

গত সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ক্লাউড স্পেসের জন্য তিনি নিজেই অর্থ পরিশোধ করেন। এর জন্য প্রতি মাসে ২০০ ডলার পর্যন্ত খরচ হয়। সফটওয়্যারের কোড অনেক বছর ধরে আপডেট না হওয়ায় সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

তিনি বলেন, 'বেবিচকের সঙ্গে আমাদের কোনো চুক্তি না থাকায় এই সফটওয়্যারের মান নিয়ে কোনো পরীক্ষা করা হয়নি।'

তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে জালিয়াতি করা সম্ভব না।

কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে দেওয়া অফিসের ঠিকানায় গত এপ্রিলে পরিদর্শন করতে যায় দ্য ডেইলি স্টার। কিন্তু সেখানে কোম্পানিটির অফিস পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাজমুল বলেন, কোম্পানিটির কোনো অফিস নেই, তারা রিমোটলি কাজ করে।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির স্বীকার করেছেন, এ৪এরো যখন এই পরিষেবাটি দিতে চেয়েছিল তখন সেটা পরীক্ষামূলক ছিল। এ কারণে এটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

তবে, এই সফটওয়্যারে বেবিচকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটা মানতে রাজি নন তিনি।

জালিয়াতির ক্ষেত্রে সফটওয়্যারটি ব্যবহারের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা এখন পর্যন্ত পরীক্ষায় কোনো ধরনের জালিয়াতির আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা প্রমাণ পাইনি। পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সব ধরনের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন সফটওয়্যার নিতে কাজ করছে বেবিচক।'