
রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। মানুষকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নিতে নতুন নতুন কৌশল নিচ্ছে তারা। কোনো কোনো ঘটনায় অজ্ঞান হওয়া ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটছে। গরমের দিন হয়ে উঠে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের জন্য সবচেয়ে সুসময়। এ সময়টাতে সাধারণ মানুষ ডাব, শরবতসহ পানীয় বেশি খাওয়ার কারণে অজ্ঞান পার্টির সুবিধা হয়। গণপরিবহনে আগের মতোই চলছে তাদের কার্যক্রম।
একসময় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অজ্ঞান করলেও সম্প্রতি তারা স্কোপোলামিন জাতীয় কেমিক্যাল ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে তারা সহজেই একজনকে অজ্ঞান করতে পারছে। এই কেমিক্যালটিকে ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ নামেও ডাকা হয়। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এ কেমিক্যালটি মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ব্যবহার করে টার্গেটকে অজ্ঞান করছে। পুলিশ, চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা স্কোপোলামিন সংগ্রহ করে কেমিক্যালের দোকান থেকে। আবার অজ্ঞান পার্টির কোনো কোনো সদস্য ব্যবহার করে লোরাজিপাম নামের ওষুধ। এই ওষুধগুলো আক্রান্ত ব্যক্তিকে ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুম পাড়িয়ে রাখতে সাহায্য করে। এগুলো ফার্মেসি থেকেই সংগ্রহ করা যায়। তবে এ ধরনের ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কোনো কোনো অসাধু দোকানি এগুলোর সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া নেশাজাতীয় দ্রব্য ডাবের পানি, শরবতের মাধ্যমে মিশিয়ে খাইয়েও অচেতন করা হয়। তবে হালে তারা স্কোপোলামিন জাতীয় কেমিক্যাল ব্যবহার করছে।
সূত্র জানায়, গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের পর কারাগারে থাকা অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির প্রায় সব সদস্য বেরিয়ে এসে আবারও একই কাজে নেমেছে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এবার তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের কবলে পড়ে প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৫ জন শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালে চিকিৎসা নিয়েছে। যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তারা তাদের বেশির ভাগই বাসের যাত্রী। মাওয়া থেকে গুলিস্তান-সায়েদাবাদ রুট, কাঁচপুর-নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ ও গুলিস্তান, গাজীপুর থেকে আব্দুল্লাহপুর, মহাখালী ও সাভার থেকে গাবতলী, মিরপুর ও চিড়িয়খানা রুটের বাসগুলোতে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বেশি তৎপর।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় দেলোয়ার হোসেন জানান, অচেতন অবস্থায় আসা ব্যক্তিদের স্টমাক ওয়াশ করা হয়। সেটি আমরা করে থাকি। গত ১৫ বছর কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কোরবানির ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় মা টেলিকম বিকাশ দোকানের ম্যানেজার লিমন প্রতিদিনের মতো গত ১২ এপ্রিল রাতে বিকাশের লেনদেন শেষে রাতে এক লাখ ১২ হাজার টাকা জমা করতে ব্যাংক বুথের দিকে যান। শিল্পকলা একাডেমির সামনে যাওয়ার পর একজন বোরকা পরা নারী একটি কল দেবেন জানিয়ে কান্নাকাটি করে তাঁর কাছ থেকে মোবাইল ফোন চান। লিমন মোবাইল দেওয়ার পর তাঁর আর কিছু মনে নেই। পরে তাঁকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তাঁর টাকা খোয়া যায়।
গত ১১ মার্চ রাজধানীর মতিঝিল থানার টিএনটি স্কুলের সামনে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন আব্দুল গাফফার (৩৫) ও মো. সুমন (২৫) নামে দুই ব্যক্তি। তারা দুজনই কাপড় ব্যবসায়ী এবং আত্মীয়। অচেতন অবস্থায় তাদের দুজনকে উদ্ধার করে রাত ৯টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে আসা মো. কামরুল হাসান জানান, তাঁরা দুজন কুমিল্লার মুরাদনগর এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী। ঢাকায় মালামাল কেনার জন্য এসেছেন। মতিঝিল টিএনটি স্কুলে সামনে রাস্তায় অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় তাঁদের।
এর আগে গত ৯ মার্চ সন্ধ্যায় ডা. সাজ্জাদ হোসেন নামের এক চিকিৎসক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকা থেকে দোয়েল পরিবহনের একটি বাসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। ওই বাসেই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন তিনি। বাসের স্টাফরা তাঁকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পেয়ে রাজধানীর গুলিস্তানে শেষ স্টপেজে আসার পর বাস থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান।
সূত্র জানায়, স্কোপেলামিন ক্লোরোফর্মের মতোই কাজ করে। পুলিশ সূত্র জানায়, ভুক্তভোগীরা বাড়তি পুলিশি ঝামেলা মনে করে মামলা করতে রাজি হয় না। ফলে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের রোধ করা কঠিন হচ্ছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (পিজি হাসাপাতাল) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এখন স্কোপোলামিন জাতীয় কেমিক্যাল ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, কেউ অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে অচেতন হলে যত দ্রুত সম্ভব তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে অচেতন ব্যক্তির হাতে মুখে পানির ছিটা দিতে হবে। ডান বা বাম দিকে কাত করে শুইয়ে রাখতে হবে। জ্ঞান ফিরলে গরম চা বা কফি খেতে দিতে হবে। এগুলো করলে কিছুটা উপশম হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘প্রায়ই অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’