Image description
সরকারি টিকার মজুত শেষ হচ্ছে চলতি মাসেই । জলাতঙ্ক রোগে মৃত্যু শতভাগ , গত বছর মৃত্যু ৫৬ । কুকুরসহ প্রাণীর কামড় , আঁচড় থেকে জলাতঙ্ক হয় ।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের সরকারি টিকার ( র‍্যাবিক্স- ভিসি ) সংকট দেখা দিয়েছে । ফলে প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের শিকার ব্যক্তিদের নিজের টাকায় টিকা কিনতে হচ্ছে । জানা গেছে , কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের কাছে মজুত টিকা চলতি মে মাসেই শেষ হচ্ছে । বেশির ভাগ জেলা - উপজেলায় স্বল্পসংখ্যক টিকা রাখা হয়েছে , যা জরুরি প্রয়োজনে প্রয়োগ করা হচ্ছে ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে , স্বাস্থ্যের কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যান ( ওপি ) না থাকায় জলাতঙ্ক টিকার এই সংকট হয়েছে । স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো , প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা , সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ , টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০ টির বেশি কর্মসূচির কার্যক্রম চলে পাঁচ বছর মেয়াদি ওপির মাধ্যমে । গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে ‘ চতুর্থ স্বাস্থ্য , জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি ( এইচপিএনএসপি )' । জুলাইয়ে পাঁচ বছরের জন্য ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার পঞ্চম এইচপিএনএসপি বা ওপি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তৎকালীন সরকার তা অনুমোদন দেয়নি । ওপি থেকে বের হওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ।

জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলের লক্ষ্যে ২০১১ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি চালু করে । সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ( সিডিসি ) শাখা এই কর্মসূচি পরিচালনা করছে । সিডিসি বলছে , জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু শতভাগ হওয়ায় ২০১১ সালে বিনা মূল্যে সারা দেশে টিকা দেওয়া শুরু করা হয় । সিডিসি সরাসরি টিকা কিনত । বর্তমানে ওপি না থাকায় সরকারের বিশেষ বরাদ্দে টিকা কিনছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ( সিএমএসডি ) ।

গত ফেব্রুয়ারিতে সিএমএসডি ১ লাখ ৪ হাজার টিকা কেনে । বর্তমানে কেন্দ্রীয়ভাবে টিকা রয়েছে প্রায় ২ হাজার । এর বাইরে জেলা ও উপজেলায় জরুরি প্রয়োগের জন্য কিছু টিকা রয়েছে । চলতি মাসেই এই টিকার মজুত শেষ হবে । প্রাণীর এই টিকার মজুত শেষ হবে । প্রাণীর আক্রমণে রক্তাক্ত আহতদের টিকা ছাড়াও অতিরিক্ত হিসেবে র‍্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ( আরআইজি ) দেওয়া হয় । সরকার এখন আরআইজি কিনছে না । এক ডোজ টিকার দাম স্থানীয় বাজারে ৫০০ টাকা । আরআইজির দাম ১ হাজার টাকা । সরকারের হিসাবে , গত বছর কুকুরসহ প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রে এসেছিলেন সোয়া ৫ লাখ মানুষ । গত বছর জলাতঙ্কের কারণে ৫৬ জনের মৃত্যু হয় । প্রাণীর আক্রমণের শিকার একজন ব্যক্তিকে তিন থেকে চার ডোজ র‍্যাবিস টিকা দেওয়া হয় । ২০২৩ সালে ৫ লাখ , ২০২২ সালে সাড়ে ৪ লাখ মানুষ ন্যূনতম তিন ডোজ করে টিকা নিয়েছেন । সারা দেশে উপজেলা , জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ চার শতাধিক টিকাকেন্দ্রে প্রাণীর আক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের টিকা দেওয়া হয় । অন্তত পাঁচটি জেলা ও উপজেলায় খোঁজ নিয়ে র‍্যাবিক্স টিকার সংকটের তথ্য জানা গেছে । রোগীরা স্থানীয় বাজার থেকে টিকা কিনে দিচ্ছেন । আরআইজিও তাঁদের কিনতে হচ্ছে ।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম জানান ,সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে টিকা আছে , তা জরুরি মুহূর্তে দেওয়ার জন্য । একই কথা বলেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা . কিশলয় সাহা । আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন , “ পাঁচ , মাস ধরে টিকার সংকট । জরুরি মুহূর্তে প্রয়োগের জন্য আমরা ৫০ ভায়াল এনে রেখেছি । কেউ গভীর রাতে আক্রান্ত হয়ে এলে তার জন্য টিকা সংগ্রহ করা কঠিন । অথবা যেসব রোগীর ক্রয়ক্ষমতা নেই , তাদের দেওয়া হচ্ছে । অথবা প্রথমটি বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে , পরে নিজেরা সংগ্রহ করে নিচ্ছে । ' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন , রাস্তাঘাটে কুকুরের সংখ্যা বেড়েছে । জলাতঙ্ক রোধে কুকুরকে টিকা দেওয়ার কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ । আবার আক্রান্ত মানুষকে দেওয়ার টিকারও সংকট দেখা দিয়েছে । কর্মসূচি না থাকায় দীর্ঘ দিনের অর্জন হুমকিতে পড়েছে । নীরবে রোগী বাড়ছে । রাজধানীর মহাখালীতে ঢাকা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চলতি বছরের শুরু থেকে গত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত কুকুর , বিড়াল , বেজি , বানর ও খ্যাঁকশিয়ালের আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসার জন্য এসেছেন সাড়ে ৪৪ হাজার মানুষ ।

আক্রমণে রক্তাক্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন সাড়ে ১৩ হাজার । ওই হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ( মেডিসিন ) ও তত্ত্বাবধায়ক ডা . মো . আরিফুল বাসার আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ আমাদের হাসপাতালে আরআইজি সরবরাহ নেই কয়েক সপ্তাহ । যাঁদের প্রয়োজন তাঁরা নিজেরা সংগ্রহ করেন । টিকার সরবরাহ পাচ্ছি । তবে অন্যান্য হাসপাতালে টিকা নেই বলে রোগী এখানে পাঠানো হয় । রাজধানী ছাড়াও সারা দেশ থেকে বহু রোগী আসেন ।' শুধু এই হাসপাতালেই গত বছর প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নেন ১ লাখ ২২ হাজার ২৬৩ জন । ২০২৩ সালে ৯৪ হাজার , ২০২২ সালে ৮৯ হাজার ৯২৮ জন চিকিৎসা নেন । এসব রোগীর মধ্যে দুই - তৃতীয়াংশই কুকুরের আক্রমণের শিকার । দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী বিড়ালের আক্রমণে শিকার । বেজি , বানর ও খ্যাঁকশিয়ালের আক্রমণের শিকার রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে , এশিয়া ও আফ্রিকাতে জলাতঙ্ক রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি । এই রোগে মৃতদের ৪০ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের কম । যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয় , জলাতঙ্কে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের জলাতঙ্ক - প্রবণ দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় । রোগটির ৯৬ শতাংশের কারণ কুকুরের কামড় । স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের ( সিডিসি ) জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের উপব্যবস্থাপক ডা . এস এম গোলাম কায়সার আজকের পত্রিকাকে বলেন , জলাতঙ্কে ২০১০ সালের আগে বছরে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হতো । জলাতঙ্ক রোগীর মৃত্যু শতভাগ । সিডিসি কর্মসূচি নেওয়ায় সেই মৃত্যু কমে দুই অঙ্কে নেমে এসেছে ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন , জলাতঙ্ক রোগে এক সপ্তাহ বা দেড় সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু হয় । ওপির কারণেই কালাজ্বর , গোদরোগ , জলাতঙ্কসহ এমন অনেক রোগ নির্মূল হয়েছে বা নির্মূলের পথে । পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া ওপি বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক নয় । স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ( সিডিসি ) ডা . মো . হালিমুর রশিদ বলেন , “ খুব হিসাব করে টিকা হাসপাতালগুলোকে দেওয়া হচ্ছে । স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আমাদের চাহিদা দিলে তা সিএমএসডিকে দেওয়া হয় , পরে তারা টিকা পাঠায় । আগে ওপির মাধ্যমে টিকা কেনা হতো । এখন সরকারের বিশেষ বরাদ্দে সিএমএসডি কিনেছে । তবে মজুত শেষের পথে । নতুন করে কেনার প্রক্রিয়া চলছে । ' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানান , স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের তৈরি র‍্যাবিসের টিকা ডব্লিউএইচও - এর প্রি- কোয়ালিফাইড নয় । টিকা কিনতে সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ডব্লিউএইচওর সনদ চাইলে তারা দিতে পারেনি । সরকার গত ১০ বছরের বেশি সময় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের টিকা কিনছে । স্থানীয় উৎপাদিত টিকা ডব্লিউএইচওর মানদণ্ডে পরীক্ষিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ( রোগ নিয়ন্ত্রণ ) ও লাইন ডিরেক্টর ( সিডিসি ) অধ্যাপক ডা . বে- নজির আহমেদ ।

আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন , ‘ আমি ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলাম । তখন সারা দেশে জলাতঙ্ক টিকা প্রয়োগ সম্প্রসারণ করেছি । টিকাকে ডব্লিউএইচও প্রি- কোয়ালিফাইড হওয়ার বাধ্যবাধকতা করেছিলাম । আমি যত দিন ছিলাম তত দিন বিদেশি প্রি - কোয়ালিফাইড টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে । ' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা . আবু জাফর আজকের পত্রিকাকে বলেন , টিকার সংকট এমনটি বলা ঠিক হবে না । সরকার বিশেষ বরাদ্দে কিনছে । স্থানীয় কোম্পানির টিকা প্রি- কোয়ালিফাইড নয় , এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে । তারা তাদের টিকা পরীক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছে ।