Image description
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর ও পাকিস্তানে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং তার জবাবে পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় দুদেশের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই সংঘাতের কারণে গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ উত্তেজনা যদি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়, তবে তা কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনার জেরে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানে অন্তত ২৬ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর জবাবে পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারতেও ১৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গভীর উদ্বেগের সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং কূটনৈতিকভাবে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ প্রভাবশালী দেশগুলো উভয় পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তবে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতার ওপর। শক্তিশালী দেশগুলো মনে করছে, দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে উদ্ভূত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান জরুরি।

সংঘাত না থামলে কী হবে: যদি এই সংঘাতের পরিস্থিতি প্রশমিত না হয়, তবে এই অঞ্চলে একাধিক গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের এই সংঘাত কূটনৈতিক সংকট আরও গভীর করতে পারে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বিনিয়োগ ঘিরেও বাড়তে পারে সংকট, কারণ যুদ্ধ বা সামরিক উত্তেজনার কারণে বিনিয়োগকারীরা দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে। এ ছাড়া আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঘিরে সংকট বাড়তে পারে, যার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। সব মিলিয়ে এই সংঘাতের ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সংঘাতের ফলে দুই দেশের কার্যকরী সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অর্থনীতিসহ যোগাযোগ খাতে সমস্যা দেখা দেবে। তবে সব দেশই চাইছে এই সংঘাত যেন আর না ছড়ায়। দিনের শেষে উভয় দেশই জানে যে, পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেলে আরও সমস্যা সৃষ্টি হবে। আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হলে পণ্য আমদানি-রপ্তানির খরচ বাড়বে এবং আমদানি প্রক্রিয়াতেও জটিলতা দেখা দেবে। পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকেও এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ব্যাপক চাপ থাকবে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, ভারতের পাল্টা আক্রমণের জবাবে পাকিস্তান যদি বড় ধরনের হামলা চালায়, তবে ভারত আবারও পাল্টা আক্রমণ করতে পারে।

তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতি বেশিদূর আগাবে না বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ। তিনি কালবেলাকে বলেন, এ ধরনের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। অতীতেও স্বল্প সময়ের জন্য খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। উভয় দেশই জানে যে যুদ্ধ তাদের জন্য ক্ষতিকর।

তার মতে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এ হামলা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, যদি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের উদ্দেশ্য থাকত, তবে ভারত সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানত। যেহেতু উভয়পক্ষই সামরিক স্থাপনা এড়িয়ে চলছে; তাই আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, এ উত্তেজনার ফলে বাণিজ্য, আকাশপথ বন্ধ এবং পানি সরবরাহ বন্ধের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যা উভয় দেশের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অবস্থান কী: ভারত ও পাকিস্তান সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পর এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ সব পক্ষই সংযম প্রদর্শন শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলেছে। এখন পর্যন্ত সব দেশেই বড় ধরনের যুদ্ধ এড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে সংঘাত ব্যাপক আকার ধারণ করলে দেশগুলোর অবস্থান বদলে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় তারা ভারতকে সমর্থন করতে পারে, অন্যদিকে চীন বরাবরই পাকিস্তানের পাশে আছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কারণ উভয় দেশই দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী শক্তি। যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করতে পারে। আবার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের ক্ষেত্রে ভারতের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তাও দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের মিত্র চীন পাকিস্তানকে কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিতে পারে এবং দেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আর্থিক সাহায্য নিয়েও এগিয়ে আসতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ মনে করেন, উভয় দেশই চাইবে এ সংঘাত নিয়ন্ত্রণে থাকুক, কারণ এটি তাদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে দ্রুত উত্তেজনা প্রশমিত না হলে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। চীন এরই মধ্যে উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে, তবে তাদের সমর্থন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা ইস্যুতে চীনের প্রতিশ্রুতি থাকায় তাদের একটি দায়বদ্ধতা রয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, চীন সরাসরি সামরিকভাবে যুক্ত হবে, তবে তারা অস্ত্র ও নৈতিক সমর্থন দিতে পারে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে যুদ্ধ লাগলে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে আগ্রহী হতে পারে। রাশিয়াও অস্ত্র বিক্রির সুযোগ খুঁজবে, তবে ইউরোপের দেশগুলো সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে কূটনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব এখন দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি বড় যুদ্ধ বহন করতে পারবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো কোনো পক্ষকেই সমর্থন করতে চাইবে না এবং কৌশলগতভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাবে। যেমনটা এখন সবাই বলছে উভয় পক্ষকে সংযত হতে। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে কৌশলগত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা কঠিন হবে এবং কোনো না কোনো দেশকে সমর্থন করতে বাধ্য হতে পারে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে তেমন কিছুই ঘটবে না এবং আলোচনার মাধ্যমেই এই উত্তেজনা প্রশমিত হবে।