
নয়ন বসাক। ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাব–ইন্সপেক্টর (এসআই)। ৩৭৮ দিন প্রশিক্ষণ করার পর চাকরিতে যোগদানের কিছুদিন পূর্বে ‘মার্চিং না করে হইচই’ করার অভিযোগে তাকে অব্যাহতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
নয়ন বসাকের বাড়ি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার শোভনা গ্রামে। তার বাবা তপন বসাক একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। দুই ভাইয়ের মধ্যে নয়ন বড়। তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। স্নাতকোত্তর চলাকালীন তিনি বাংলাদেশ ৪০তম ক্যাডেট এসআই-এর চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখ রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে ১ বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য যোগদান করায় স্নাতকোত্তর শেষ করতে পারেননি তিনি।
এদিকে, প্রশিক্ষণের শেষ দিকে এসে অব্যাহতি পান নয়ন। এ প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, ৩৭৮ দিন ট্রেনিং শেষ করার পর ক্লাসে যাওয়ার সময় সঠিক ভাবে মার্চিং না করে উচ্চস্বরে হইচই করার অভিযোগে আমাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই দিন রাতের ক্লাসে আমি সুশৃঙ্খল ভাবেই মার্চিং করে ওস্তাদজী’র কমান্ডে ক্লাসরুমে যাই, যেটার প্রমাণ অ্যাকাডেমির সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই পাওয়া যাবে। পরবর্তীতে আমাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলে, আমি প্রমান সহ ব্যাখ্যা যথাসময়ে দাখিল করি। কিন্তু একাডেমি কর্তৃপক্ষ আমার জবাব আমলে না নিয়ে ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর আমিসহ মোট ৩ জনকে অব্যাহতি প্রদান করে।
তিনি আরও বলেন, একবছর মেয়াদি এই বেসিক ট্রেনিং ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ শুরু হয়ে ২০২৪ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেনো জানি না একাডেমি কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টভাবে সময় বাড়াতে থাকে, দীর্ঘ ১ বছরেরও বেশী সময় (৩৭৮ দিন) হাড়ভাঙা ট্রেনিং শেষে বিনা অপরাধে শূন্য হাতে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে মাথা উঁচু করে আমি ও আমার পরিবারের বাঁচার কথা ছিল, সেখানে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছি। তারা মনে করেন আমি না জানি কত বড় অপরাধ করেছি, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা জানেন আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। অরাজনৈতিক ক্যাম্পাসে পড়েছি, রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই, আমার পরিবারও রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। কোনো অনৈতিক পন্থাও অবলম্বন করেনি। প্রশিক্ষণ চলাকালীন অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সব কাজ করেছি, তবুও কেন আমাকে বাদ দেওয়া হলো সে কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছি।
নয়ন বলেন, ট্রেনিং চলাকালে ১১ ফিট উঁচু দেওয়ালে উঠতে গিয়ে আমার বাম হাঁটু ফ্রাকচার হয়, যা এখনো অবধি পুরোপুরি ভালো হয়নি। সব থেকে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে আমার অব্যাহতি পাওয়ার ৩ মাস পরেই বাবা রিটায়ার করেন। আমি পরিবারের বড় সন্তান, দায়িত্ব অনেক। ইচ্ছা ছিল এই চাকরি পেয়ে পরিবারের হাল ধরব, কিন্তু এই রাষ্ট্র বিনা অপরাধে আমাকে পরিবার ও সমাজের বোঝা বানিয়ে দিলো। আমার ছোট ভাই এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর্থিক অনটনে থাকায় ভাইটার ঠিকমতো যত্ন নিতে পারছি না। বিষয়টা ভাবলেই খুব কষ্ট হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাবার সামান্য কিছু জমানো টাকা দিয়ে কোনো মতে আমাদের সংসার চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভাইবা দিলেও এসআই থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় কেউ নিতে আগ্রহী নয়। যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় কোনো ব্যবসাও শুরু করতে পারছি না, তাই বাধ্য হয়ে এখন কৃষি কাজ করছি। মাথায় করে গোবর সারের বোঝা বইতে গিয়ে আমি চোখে মুখে অন্ধকার দেখতাম, দম যেন বের হয়ে আসতে চাইতো। আসলে ১ বছরের হাড়ভাঙা ট্রেনিং শেষে এই ধকল শরীর নিতে পারতো না। কোদাল চালাতে গিয়ে হাতে ফোসকা পড়ে যেত। এমন অনেক দিন গেছে যেদিন কাজ করতে গিয়ে হয় হাত কেটে গেছে নয়তো পা ছিলে গেছে। প্রতিবেশীরা আমার এ অবস্থা দেখে হাসাহাসি করতো, তখন মনের অজান্তে চোখে জল চলে আসত। আর আমি সোজা উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতাম, হে ঈশ্বর কি অপরাধ আমার? জীবনে কারো কোনো ক্ষতি করিনি, তাহলে আমার সাথে এমন হলো কেনো? তারপর সবার অলক্ষ্যে চোখের জল মুছে কাজে লেগে পড়তাম।
তিনি আরও বলেন, এই ভীষণ খারাপ লাগা থেকে আমি বেরই হতে পারছি না। এই ৬ মাসে আমি হাসতে ভুলে গেছি। মাঝে মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তাও মাথায় আসত, কিন্তু পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি। সংসারে এতগুলো মুখ, জানি না কবে হাসি ফোটাতে পারব। এখন পরিবারের জন্য কৃষি কাজ করি আর সৃষ্টিকর্তাকে বলি, এমন মন্দভাগ্য যেন কারো না হয়।