Image description

‘১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ’— সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে এমন খবরে তুলকালাম শুরু হয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) বরাবর পাঠানো চিঠির মাধ্যমে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে খবরে দাবি করা হয়। যদিও অনিয়মের কারণে এখনই ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে’— এ ধরনের কোনো সুপারিশ বা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে ইউজিসি। 

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে ইউজিসি সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, আইন না মানা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত চলমান প্রক্রিয়া। এর আগেও এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউসিজি। সম্প্রতি মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাওয়া পর গত সপ্তাহে আমরা বসেছিলাম। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন সেগুলো আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। তবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দেওয়ার মতো কোনো সিদ্ধান্ত ইউসিজি থেকে নেওয়া হয়নি।

আর ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক ড. মো. সুলতান মাহমুদ ভুইয়া বলেন, ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছে। আমরা সভা করছি, তাদের নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তবে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। সিদ্ধান্ত হলে জানানো হবে। ইউজিসি পরিচালক বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার সামর্থ্য আমাদের নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখাটাই আমাদের গর্বের। আমরা সেটাই চেষ্টা করছি। 

তথ্যমতে, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয় ২০১০ সালের আইন দিয়ে। যদিও বছরের পর বছর সেই আইন তোয়াক্কা করে না অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি এসব উচ্চশিক্ষালয়ের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে চিঠি ইউজিসি বরাবর চিঠি দিয়েছে তদারক প্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ৮ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব এ এস এম কাসেম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ইউজিসি চেয়ারম্যানকে বলা হয়, ‌‌'১৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক অনুমতির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও শিক্ষা কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করেনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর ধারা ১২(১) অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।'

’১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছে। আমরা সভা করছি, তাদের নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তবে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। সিদ্ধান্ত হলে জানানো হবে। ইউজিসি পরিচালক বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার সামর্থ্য আমাদের নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখাটাই আমাদের গর্বের। আমরা সেটাই চেষ্টা করছি।’ ড. মো. সুলতান মাহমুদ ভুইয়া, পরিচালক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০–এর ১২(১) ধারায় বলা আছে, ‘কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদের মধ্যে বা ক্ষেত্রমতে নবায়নকৃত সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদের মধ্যে সনদপত্রের জন্য আবেদন করতে ব্যর্থ হলে অথবা সনদপত্র প্রাপ্তির জন্য ধারা ৯–এর কোনো শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সাময়িক অনুমতিপত্র বা ক্ষেত্রমতে নবায়নকৃত সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ অবসানের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও শিক্ষা–সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইস্যুকৃত ১২ (১) ধারার আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টিকেই ১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিসহ সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন অনেকে। যদিও ইউজিসি বলছে, মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশনার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সতর্ক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মঞ্জুরী কমিশন। এখানে ভর্তি ও শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের মত কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেননি।

এর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য ১৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়েছিল ইউজিসি। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে না পারায় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ, দুটির অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তিতে নিষেধাজ্ঞা এবং বাকি ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে আলাদা আলাদা সময়সীমা দেওয়া দিয়েছিল তদারক প্রতিষ্ঠান। পরে সময়সীমা মেনে স্থায়ী ক্যাম্পাসে পাঠদান শুরু করে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে যারা বিভিন্ন কারণে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি, তাদের বিষয়ে নতুন করে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয় উচ্চশিক্ষা তদারককারী এই প্রতিষ্ঠান। যদিও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে সেই নিষেধাজ্ঞায় পরিবর্তন আসে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট উচ্চশিক্ষালয় বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বলে যে খবর সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে নড়েচড়ে বসেছে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পাশাপাশি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এ খবরে উদ্বিগ্ন প্রকাশ করেছে। জানতে চাইলে তালিকায় থাকা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৬ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে, এটি পুরোপুরি ভুল ও বিভ্রান্তিকর। এখনো পর্যন্ত আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি থেকে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক নোটিশ পাইনি। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অহেতুক উদ্বিগ্ন না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল সোর্স থেকেই তথ্য গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি। আমাদের সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলছে।

এইচএসসি পাস করা এক ভর্তিচ্ছু বলেন, ‘১৬ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দিন আগে আমি ভর্তি হয়েছি। হঠাৎ করে বন্ধের খবর শুনে আমি এবং আমার পরিবার খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছি। আমরা চাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে বিষয়টি স্পষ্ট করুক।’

১৬ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নতুন করে কী ভাবছে ইউজিসি?
গত ৮ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়ার পর সম্প্রতি বৈঠকে বসে ইউজিসি। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তার বিষয়ে সভা করে প্রতিষ্ঠানটি। সভা সূত্রে জানা যায়, ১৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের বিষয় মন্ত্রণালয়ে রেজুলেশন আকারে পাঠানো হবে। পরে চিঠি দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে।

নতুন কোনো ব্যাচ ভর্তি করানো যাবে না; আগের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চলবে;  সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেধে দেওয়া হবে— মোটা দাগে সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সভা সূত্রে জানা গেছে। 

সভা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক ড. মো. সুলতান মাহমুদ ভুইয়া দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছে। আমরা সভা করছি তাদের নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তবে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। সিদ্ধান্ত হলে জানানো হবে।

ইউজিসি পরিচালক বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার সামর্থ্য আমাদের নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু রাখাটাই আমাদের গর্বের। আমরা সেটাই চেষ্টা করছি।শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনার সংবাদ তো সবাই উদ্বিগ্ন হবে সেটা স্বাভাবিক। ২০১০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন যথাযথ প্রয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, আইনটি এতোদিন যথাযথ প্রয়োগ হয়নি। এখন সেটা নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছে।

এর আগে ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছিলেন, ১৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম নিয়ে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। সেই প্রতিবেদনের আলোকে ইউজিসিকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয়
ভর্তিসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশের খবরে নড়েচড়ে বসেছে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আজ মঙ্গলবার (৬ মে) মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস) এক বিবৃতিতে বলছে, এখন পর্যন্ত ইউজিসি থেকে বিইউএইচএস-এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজকে কোন নির্দেশনা প্রেরণ করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীবৃন্দকে প্রকাশিত সংবাদে উদ্বিগ্ন না হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। এছাড়া বিবৃতি দিয়েছে খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ফেনীর ফেনী ইউনিভার্সিটিসহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যমতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে ৭ বছর, পরে আরও ৫ বছর সময় পায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এর মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে না পারলে শিক্ষার্থী ভর্তিসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে ইউজিসি। ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন মানলে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের করার এখতিয়ারও রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির। মূলত সেই ক্ষমতাবলেই চিঠি ইস্যু করে মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় জারি করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো— ঢাকার মোহাম্মদপুরের দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সাতমসজিদ রোডের ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, সিদ্ধেশ্বরীর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, রাজারবাগের দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, গুলশানের প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, বনানীর প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, শ্যামলীর আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, পান্থপথের সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস,  সিলেটের নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, কিশোরগঞ্জের ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,  খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ফেনীর ফেনী ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি।