Image description

Jubayer Faisal (জুবায়ের ফয়সাল)


২০১৩ সালের পহেলা এপ্রিল, সোমবার। গুলশানে বিএনপির একটা বিক্ষোভ সমাবেশ ছিলো। কারণ, তার আগের রাতে গুলশানে বিএনপির কার্যালয়ে পুলিশের পাহারায় গুলি করেছিলো ছাত্রলীগের পান্ডারা। বেগম জিয়া তখন কার্যালয়ের ভেতরেই ছিলেন। আমি তখন দিগন্ত টিভির রিপোর্টার। সেদিন গুলশানে আমাদের তিনটা ইউনিট থাকার কথা ছিলো, তিন রিপোর্টারের একজন নুর আলম ভাই, আরেকজন মঞ্জুর মিলন ভাই, আর থাকার কথা ছিলো আমার। তার আগে বেশ কদিন ধরে আমার ঠান্ডা জ্বর লেগেই ছিলো, এইটা মূলত ফেব্রুয়ারিতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নির্যাতনের পর থেকেই চলছিলো। তবুও অফিস কামাই দেইনি। কিন্তু সেদিন ভোর থেকে জ্বরের মাত্রা এতো তীব্র হলো যে বিছানা থেকে ওঠারই ক্ষমতা ছিলো না। তখন আমি শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের ১০ তলায় থাকি। আমাদের বাসায় একটা ছেলে ছিলো, ওর নাম জিতু। বাজার সদাই রান্নাবান্না সবই ও করতো। আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিলো সকাল ১০টায়। কিন্তু ভোর থেকে জ্বরে কাহিল আমি ভুলেই গেছিলাম আমার যে অফিস আছে।
 
শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকায়, সকাল নয়টার কিছু পরে আমি ফোন করেছিলাম অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর কামরুজ্জামান বাবলু ভাইকে। উনি রিসিভ করেননি। পরে আমি একটা টেক্সট দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর বাবলু ভাই ফোন ব্যাক করেছিলেন। এমনিতে উনি অসাধারণ মানুষ, আমার জীবনের বহু উত্থান পতনের সাক্ষী বাবলু ভাই। কিন্তু সেদিন কেন যেন একটু রেগে গিয়েছিলেন। হয়তো ইলেভেনথ আওয়ারে অসুস্থতার কথা বলেছি বলে। সারাদিন আর মাথা তুলতে পারিনি। সেদিন গুলশানসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শরীর একটু ভালো লাগায় পরেরদিন অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এজন্য বিকেলের দিকে আমি বাবলু ভাইকে আরেকটা টেক্সট করি। কিন্তু ভাই কোন রিপ্লাই দেননি সেদিন। রাতে মেইলে আসা পরেরদিনের অ্যাসাইনমেন্ট শীটে দেখি আমার নাম নেই। এমনকি তার পরেরদিনেও শীটে আমার নাম নেই। তৃতীয় দিন বুধবার শরীর আরো খারাপ হয়ে যায় আমার। জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে থাকি।
 
জিতু সেদিন সকালবেলা দু দফা মাথায় পানি দিয়ে বাজার করতে বের হয়ে গিয়েছিলো। সাইফুল ভাই ইউসুফ ভাই সবাই অফিসে চলে গেছেন। বাসায় আমি একদমই একা। জিতু বের হওয়ার মিনিট দশেক পর বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি ভাবলাম জিতু বোধহয় ভুলে চাবি ফেলে গেছে। বেল শুনতেছি কিন্তু ওঠার ক্ষমতা নেই আমার। আবার বেল বাজছে। কিছুক্ষন বেল বাজার পর অনেক কষ্টে উঠলাম, দেয়াল ধরে ধরে গিয়ে দরজা খুলে দেখি আমার জন্য দরজায় অপেক্ষা করছে এক বিরাট বিস্ময়। আমার সামনে দাঁড়ানো স্বয়ং শহীদ মীর কাশেম আলী স্যার নিজে। সঙ্গে স্যারের ড্রাইভার দুহাতে অনেকগুলো ফলের প্যাকেট তার এবং একজন ডাক্তার, প্রেসক্রিপশন দেখে পরে জেনেছিলাম উনি পিজির ডা. আসিফ রহমান। আমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আপনি?
উনি বললেন, দরজায়-ই কথা বলবা? আমি অত্যন্ত লজ্জা পেলাম। আমার রুম তখন ভয়াবহ অগোছালো। একদিকে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, আরেকদিকে উনাকে কোথায় বসতে দেবো সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। স্যার বললেন ব্যস্ত হয়ো না, বলে নিজেই চেয়ার টেনে বসলেন। ডাক্তার আসিফকে বললেন আমাকে চেক করার জন্য আর ড্রাইভার ভাইকে বললেন আঙ্গুর আর আপেল ধুয়ে আমাকে খাওয়ানোর জন্য। আমাকে দেখে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে বলে জানালেন ডাক্তার। ফোন দিয়ে সেই সময়েই আরেকজনকে দিয়ে সিরিঞ্জ আর টিউব আনালেন। রক্ত নিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ল্যাবে। কিছু ঔষধ দিলেন, নীচে পাঠিয়ে ড্রাইভার ভাইকে দিয়ে কিনেও আনালেন মীর কাশেম আলী স্যার। প্রায় দেড়ঘন্টা আমার বাসায় ছিলেন স্যার। আমার পড়াশুনা থেকে পরিবার, সবকিছুর খোঁজ নিলেন। আমি তখন অন্য এক ঘোরের মধ্যে। কোনভাবেই ভেবে পাচ্ছিলাম না আমার মতো একজন ছোট্ট কর্মীর অসুস্থতায় এতো এতো বিশাল সব প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা এতোটা উদ্বিগ্ন হন কিভাবে?
 
্যার সেদিন চলে গেলেন, কিন্তু আমার গোটা জীবনের উপর রেখে গেলেন বিশাল এক পরশপাথরের ছোঁয়া। যাওয়ার সময় বলে গেলেন সম্পুর্ণ সুস্থ না হয়ে অফিসে যেও না।
৫ মে ২০১৩। সেদিন আমি দিগন্তের সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার নয়ন মুরাদের সহকারী হিসেবে ভোর থেকে অ্যাসাইনমেন্টে কাঁচপুর ব্রীজে। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা রাত থেকেই ঢাকায় আসতে শুরু করেছেন। ঐটা ছিলো ঢাকার একটা বিশাল প্রবেশমুখ। সাধারণত এসব বড় ইভেন্টে আমাকে কারো সঙ্গে পাঠানো হতো। হয়তো দিগন্তের নিউজরুমের পূর্ণ আস্থাভাজন ছিলাম না বলে। তা না হলে ঐদিন ঢাকায় হেফাজতের হেডকোয়ার্টারখ্যাত লালবাগ মাদ্রাসায় অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছিলো আমারও একমাস পর দিগন্তে জয়েন করা এক বিখ্যাত সাংবাদিককে, দিগন্ত বন্ধ হওয়ার পেছনে সেদিন যে কয়েকটি কারণ ঘটেছিলো তার মধ্যে অন্যতম একটা ঘটেছিলো তার হাতেই, অথচ আমাকে মাঠে পাঠানো হয়েছিলো নয়ন ভাইয়ের সহকারী হিসেবে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিলো সব, এরপর চেঞ্জ হতে থাকে পরিস্থিতি। বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় সংঘর্ষ। সারাদিন টিয়ারশেলের ধোয়া আর পায়ে ছররা গুলি খেয়ে রাত দুইটার পর অফিসে ফিরে ক্লান্তিতে চোঁখ বুজে আসছে। শোভন ভাই, সায়েমভাই, নাহিয়ান ভাইসহ আমরা প্রায় ২৫/৩০জন সহকর্মী সেই রাতে বিক্ষিপ্তভাবে শুয়ে পড়ি টক শোর স্টুডিওতেই।
 
৫ মে ২০১৩, দিবাগত রাত ৪টা ২০! তখনকার ডিবি ডিসি মোল্লা নজরুল আসলেন, দেখলেন এবং বন্ধ করলেন। দেশের তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় টেলিভিশন দিগন্ত শাটডাউন হয়ে গেলো সাময়িক সময়ের জন্য। যে সাময়িকের মেয়াদ শেষ হয়নি আজো। সে রাতে মোল্লা নজরুল যখন নিজ হাতে সার্ভারের তারগুলো টান দিয়ে খুলছিলেন, আমার বারবার মনে পড়ছিলো অসুস্থ আমার পাশে বসে মীর কাশেম আলী স্যারের বলা “দিগন্ত একটা স্বপ্নের নাম, এই স্বপ্ন শুধু আমার কিংবা আমাদের না, এই স্বপ্নের মালিক গোটা বাংলাদেশ” তোমরা শুধু দিগন্তের না, গোটা বাংলাদেশের জিম্মাদার, সবসময় মনে রেখো।
 
সেদিন দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো আমাদের অনেকের পেশাগত জীবনের দরজা। বন্ধ হয়েছিলো নতুন নতুন স্বপ্ন দেখা। বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো গণমাধ্যমের ডানায় ভর করে উড়তে থাকা বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক গণতান্ত্রিক মুক্তির সংগ্রাম। সেদিন দিগন্ত বন্ধ না হলে হয়তো কখনো বুঝতেই পারতাম না, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের উপরতলায় কি পরিমান রেসিজম আর বৈষম্যের চর্চা হয়। কিভাবে টেলিভিশনের হর্তাকর্তারা ব্যবসায়িক লাভের জন্য আরেকটা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগের পূর্ণ ফায়দা তোলে, কিভাবে ২০ হাজার টাকা বেতনের একজন সাংবাদিকের অসহায়ত্ব পুঁজি করে ১০ হাজার টাকায় চাকরি করার প্রস্তাব দেয়া হয়, কিভাবে রাজনৈতিক বাসনা পূরণের জন্য শতশত বেকার যুবকের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে কতিপয় লুটেরা ! আমাদের চোখের সামনেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো গণমাধ্যমের মালিক হিসেবে একজন মীর কাশেম আলীর সঙ্গে কি আকাশ পাতাল বৈপরীত্য অন্যদের !
 
৫ মে ২০২৫। প্রিয় দিগন্ত টেলিভিশন, বাংলাদেশ থেকে কয়েকহাজার মাইল দুরের এক শহরে বসে আমি আজো অনুভব করি তোমাকে। তুমি সাময়িকভাবে অপমৃত্যুর শিকার না হলে হয়তো আজ জীবনটা সাজতো অন্য কোন রঙে। ফিরে এসো দিগন্ত, আবারো নীল সাদার ভেলায় ভাসো সত্য ও সুন্দরের পক্ষে। শহীদ মীর কাশেম আলী মিন্টুর দেখানো পথে আবারো হয়ে ওঠো বাংলার ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্নসারথী।